পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8૧૨ গল্পগুচ্ছ শিখিয়াছিল, বাহ হইতে নিগমন শেখে নাই—নদীর স্রোত সেইরাপ গিরিদরীর পাষাণ-জঠরের মধ্যে থাকিয়া কেবল সমখেই চলিতে শিখিয়াছিল, পশ্চাতে ফিরিতে শেখে নাই। হায় নদীর স্রোত, হায় যৌবন, হায় কাল, হায় সংসার, তোমরা কেবল সম্মখেই চলিতে পার—যে পথে সমতির বর্ণমণ্ডিত উপলখণ্ড ছড়াইয়া আস সে পথে আর কোনোদিন ফিরিয়া যাও না। মানুষের মনই কেবল পশ্চাতের দিকে চায়, অনন্ত জগৎসংসার সে দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।’ এমনসময় মন্দার বারের কাছে একটি ছায়া পড়িল, সে ছায়া মন্দা দেখিতে পাইল। কিন্তু যেন দেখে নাই এইরুপ ভান করিয়া অনিমেষদটিতে অমলের মুখের দিকে চাহিয়া নিবিড় মনোযোগের সহিত পড়া শুনিতে লাগিল। ছায়া তৎক্ষণাৎ সরিয়া গেল । চার অপেক্ষা করিয়া ছিল, অমল আসিলেই তাহার সম্মখে বিশ্বববন্ধ কাগজটিকে যথোচিত লাঞ্ছিত করিবে, এবং প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিয়া তাহাদের লেখা মাসিক পত্রে বাহির করিয়াছে বলিয়া অমলকেও ভৎসনা করিবে । অমলের আসিবার সময় উত্তীণ হইয়া গেল তব তাহার দেখা নাই। চার একটা লেখা ঠিক করিয়া রাখিয়াছে; অমলকে শনাইবার ইচ্ছা; তাহাও পড়িয়া আছে । এমনসময়ে কোথা হইতে অমলের কন্ঠস্বর শনা যায়। এ যেন মন্দার ঘরে। শরবিন্ধের মতো সে উঠিয়া পড়িল। পায়ের শব্দ না করিয়া সে বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অমল যে লেখা মন্দাকে শনাইতেছে এখনও চার তাহা শোনে নাই। অমল পড়িতেছিল— মানুষের মনই কেবল পশ্চাতের দিকে চায়-- অনন্ত জগৎসংসার সে দিকে ফিরিয়াও তাকায় না ? চার যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল তেমন নিঃশব্দে আর ফিরিয়া যাইতে পারিল না। আজ পরে পরে দই তিনটা আঘাতে তাহাকে একেবারে ধৈর্যচ্যুত করিয়া দিল । মন্দা যে একবণও বুঝিতেছে না এবং অমল যে নিতান্ত নিবোধ মঢ়ের মতো তাহাকে পড়িয়া শনাইয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছে, এ কথা তাহার চীৎকার করিয়া বলিয়া আসিতে ইচ্ছা করিল। কিন্তু না বলিয়া সক্রোধ পদশব্দে তাহা প্রচার করিয়া আসিল। শয়নগহে প্রবেশ করিয়া চার বার সশব্দে বন্ধ করিল। অমল ক্ষণকালের জন্য পড়ায় ক্ষাত দিল। মন্দা হাসিয়া চাররে উদ্দেশে ইঙ্গিত করিল। অমল মনে-মনে কহিল, “বউঠানের এ কী দৌরাত্ম্য। তিনি কি ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন, আমি তাঁহারই ক্রীতদাস। তাঁহাকে ছাড়া আর কাহাকেও পড়া শনাইতে পারিব না। এ যে ভয়ানক জলম।” এই ভাবিয়া সে আরও উচ্চৈঃস্বরে মন্দাকে পড়িয়া শনাইতে লাগিল। পড়া হইয়া গেলে চারীর ঘরের সম্মুখ দিয়া সে বাহিরে চলিয়া গেল। একবার চাহিয়া দেখিল, ঘরের বার রন্ধ। চার পদশব্দে বঝিল, অমল তাহার ঘরের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল—একবারও থামিল না। রাগে ক্ষোভে তাহার কান্না আসিল না। নিজের নতন-লেখা খাতাখনি বাহির করিয়া তাহার প্রত্যেক পাতা বসিয়া বসিয়া টকরা টকরা করিয়া ছিড়িয়া সতপোকার করিল। হায়, কী কুক্ষণেই এই-সমস্ত লেখালেখি আরম্ভ হইয়াছিল ।