পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খোকাবাবরে প্রত্যাবতন 86 বলিত, বৎস, ভালোবাসিয়া আমার ঘরে আসিয়াছ বলিয়া যে তোমার কোনো অযত্ন হইবে, তা হইবে না।’ এমনি করিয়া বারো বৎসর কাটিয়া গেল। ছেলে পড়ে-শনে ভালো এবং দেখিতেশনিতেও বেশ, হস্টপষ্ট উন্জল শ্যামবর্ণ—কেশবেশবিন্যাসের প্রতি বিশেষ দষ্টি, মেজাজ কিছু সখী এবং শৌখিন। বাপকে ঠিক বাপের মতো মনে করিতে পারিত না। কারণ, রাইচরণ স্নেহে বাপ এবং সেবায় ভূত্য ছিল, এবং তাহার আর-একটি দোষ ছিল—সে যে ফেলনার বাপ এ কথা সকলের কাছেই গোপন রাখিয়াছিল। যে ছাত্রনিবাসে ফেলনা বাস করিত সেখানকার ছাত্ৰগণ বাঙাল রাইচরণকে লইয়া সবাদা কৌতুক করিত, এবং পিতার অসাক্ষাতে ফেলনাও যে সেই কৌতুকালাপে যোগ দিত না তাহা বলিতে পারি না। অথচ নিরীহ বৎসলস্বভাব রাইচরণকে সকল ছাত্রই বড়ো ভালোবাসিত ; এবং ফেলনাও ভালোবাসিত, কিন্তু পবেই বলিয়াছি, ঠিক বাপের মতে নহে, তাহাতে কিঞ্চিৎ অনুগ্রহ মিশ্রিত ছিল । রাইচরণ বন্ধ হইয়া আসিয়াছে। তাহার প্রভু কাজকমে সব দাই দোষ ধরে । বাসতবিক তাহার শরীরও শিথিল হইয়া আসিয়াছে, কাজেও তেমন মন দিতে পারে না, কেবলই ভুলিয়া যায়— কিন্তু যে ব্যক্তি পরা বেতন দেয় বাধক্যের ওজর সে মানিতে চাহে না । এ দিকে রাইচরণ বিষয় বিক্ৰয় করিয়া যে নগদ টাকা সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়াছিল তাহাও নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। ফেলনা আজকাল বসনভূষণের অভাব লইয়া সব দা খংখ:ং করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদ একদিন রাইচরণ হঠাৎ কমে জবাব দিল এবং ফেলনাকে কিছু টাকা দিয়া বলিল, আবশ্যক পড়িয়াছ, আমি কিছুদিনের মতো দেশে যাইতেছি।” এই বলিয়া বারাসতে গিয়া উপস্থিত হইল। আনকোলবাব তখন সেখানে মন্সেফ ছিলেন। অনকেলের আর দ্বিতীয় সন্তান হয নাই, গহিণী এখনো সেই পত্ৰশোক বক্ষের মধো লালন করিতেছিলেন । একদিন সন্ধ্যার সময় বাব কাছারি হইতে আসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন এবং কত্রী একটি সন্ন্যাসীর নিকট হইতে সন্তানকামনায় বহুমুল্যে একটি শিকড় ও আশীবাদ কিনিতেছেন -- এমন সময়ে প্রাঙ্গণে শব্দ উঠিল, “জয় হোক, মা ।” বাব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে রে ।” রাইচরণ আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, “আমি রাইচরণ ।” বন্ধকে দেখিয়া অনুকলের হৃদয় আদ্র হইয়া উঠিল । তাহার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সহস্র প্রশন এবং আবার তাহাক কমে নিয়োগ করিবার প্রস্তাব করিলেন । রাইচরণ ম্লান হাস্য করিষা কহিল, “মাঠাকরনকে একবার প্রণাম করিতে চাই।” অনকেল তাহাকে সঙ্গে করিয়া অতঃপরে লইয়া গেলেন। মাঠাকরন রাইচরণকে তেমন প্রসন্ন ভাবে সমাদর করিলেন না-- রাইচরণ তৎপ্রতি লক্ষ না করিয়া জোড়হন্তে কহিল, “প্রভু, মা, আমিই তোমাদের ছেলেকে চুরি করিয়া লইয়াছিলাম। পামাও নয়, আর কেহও নয়, কৃতঘ্য অধম এই আমি—”