পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& 6:8 গল্পগুচ্ছ শংকর কহিলেন, "দাদা সন্ন্যাসীর নিকট হইতে লিখন পাইয় অবধি আমার কাছে তাহা বিধিমতে লুকাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কিন্তু তিনি যতই গোপন করিতে লাগিলেন আমার ঔৎসুক্য ততই বাড়িয়া উঠিল। তিনি দেবীর আসনের নীচে বাক্সের মধ্যে ঐ লিখনখানি লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন, আমি তাহার সন্ধান পাইলাম, আর দ্বিতীয় চাবি বানাইয়া প্রতিদিন অলপ অলপ করিয়া সমস্ত কাগজখানা নকল করিতে লাগিলাম। যেদিন নকল শেষ হইল সেইদিনই আমি এই ধনের সন্ধানে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইলাম। আমারও ঘরে অন্যথা সত্রী এবং একটি শিশসন্তান ছিল। আজ তাহারা কেহ বাঁচিয়া নাই। “কত দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করিয়াছি তাহা বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন নাই । সন্ন্যাসীদত্ত এই লিখন নিশ্চয় কোনো সন্ন্যাসী আমাকে বঝাইয়া দিতে পরিবেন, এই মনে করিয়া অনেক সন্ন্যাসীর আমি সেবা করিয়াছি। অনেক ভণ্ড সন্ন্যাসী আমার ঐ কাগজের সন্ধান পাইয়া তাহা হরণ করিবারও চেষ্টা করিয়াছে। এইরপে কত বৎসরের পর বৎসর কাটিয়াছে, আমার মনে এক মহেতের জন্যও সুখ ছিল না, শান্তি ছিল না। “অবশেষে পর্বজন্মাজিত পণ্যের বলে কুমায়ন পবতে বাবা স্বরুপানন্দ স্বামীর সঙ্গ পাইলাম। তিনি আমাকে কহিলেন, ‘বাবা, তৃষ্ণা দরে করো, তাহা হইলেই বিশ্বব্যাপী অক্ষয় সম্পদ আপনি তোমাকে ধরা দিবে। “তিনি আমার মনের দাহ জড়াইয়া দিলেন । তাঁহার প্রসাদে আকাশের আলোক আর ধরণীর শ্যামলতা আমার কাছে রাজসম্পদ হইয়া উঠিল । একদিন পবতের শিলাতলে শীতের সায়াহ্নে পরমহংস-বাবার ধর্মনিতে আগন জনলিতেছিল— সেই আগনে আমার কাগজখানা সমপণ করিলাম। বাবা ঈষৎ একট হাসিলেন। সে হাসির অথ তখন বুঝি নাই, আজ বুঝিয়াছি। তিনি নিশ্চয় মনে-মনে বলিয়াছিলেন, কাগজখানা ছাই করিয়া ফেলা সহজ, কিন্তু বাসনা এত সহজে ভস্মসাৎ হয় না। "কাগজখানার যখন কোনো চিহ্ন রহিল না তখন আমার মনের চারি দিক হইতে একটা নাগপাশ-বন্ধন যেন সম্পণেরপে খলিয়া গেল। মন্তির অপব আনন্দে আমার চিত্ত পরিপন্ণ হইয়া উঠিল। আমি মনে করিলাম, এখন হইতে আমার আর-কোনো ভয় নাই— আমি জগতে কিছুই চাহি না। “ইহার অনতিকাল পরে পরমহংস-বাবার সঙ্গ হইতে চু্যত হইলাম। তাঁহাকে অনেক খুজিলাম, কোথাও তাঁহার দেখা পাইলাম না । “আমি তখন সন্ন্যাসী হইয়া নিরাসক্তচিত্তে ঘরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। অনেক বৎসর কাটিয়া গেল—সেই লিখনের কথা প্রায় ভুলিয়াই গেলাম । “এমন সময় একদিন এই ধারাগোলের বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একটি ভাঙা মন্দিরের মধ্যে আশ্রয় লইলাম। দই-একদিন থাকিতে থাকিতে দেখিলাম, মন্দিরের ভিতে স্থানে স্থানে নানাপ্রকার চিহ্ন অাঁকা আছে। এই চিহ্নগুলি আমার পাব পরিচিত। “এক কালে বহুদিন যাহার সন্ধানে ফিরিয়াছিলাম তাহার যে নাগাল পাওয়া যাইতেছে তাহাতে আমার সন্দেহ রহিল না। আমি কহিলাম, এখানে আর থাকা হইবে না, এ বন ছাড়িয়া চলিলাম।" “কিন্তু ছাড়িয়া যাওয়া ঘটিল না। মনে হইল, দেখাই যাক-না, কণী আছে—কৌতুহল একেবারে নিবত্ত করিয়া যাওয়াই ভালো। চিহ্নগলা লইয়া অনেক আলোচনা করিলাম: