পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○bf গল্পগুচ্ছ করিয়া দিল। কখনো বা একটা সোনার পাত মাটিতে ফেলিয়া তাহার উপরে বারবার পদাঘাত করিতে লাগিল। মনে মনে বলিতে লাগিল, পৃথিবীতে এমন সম্রাট কয়জন আছে যাহারা সোনা লইয়া এমন করিয়া ফেলাছড়া করিতে পারে। মৃত্যুঞ্জয়ের যেন একটা প্রলয়ের রোখ চাপিয়া গেল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, এই রাশীকৃত সোনাকে চণ করিয়া ধুলির মতো সে ঝাঁটা দিয়া ঝাঁট দিয়া উড়াইয়া ফেলে— আর এইরপে পৃথিবীর সমস্ত সবেণলব্ধ রাজা-মহারাজকে সে অবজ্ঞা করিতে পারে। এমনি করিয়া যতক্ষণ পারিল মৃত্যুঞ্জয় সোনাগলোকে লইয়া টানাটানি করিয়া শ্ৰান্তদেহে ঘামাইয়া পড়িল। ঘমে হইতে উঠিয়া সে আবার তাহার চারি দিকে সেই সোনার স্তপে দেখিতে লাগিল। সে তখন বারে আঘাত করিয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ওগো সন্ন্যাসী, আমি এ সোনা চাই না— সোনা চাই না !" কিন্তু, বার খলিল না। ডাকিতে ডাকিতে মৃত্যুঞ্জয়ের গলা ভাঙিয়া গেল, কিন্তু বার খলিল না। এক-একটা সোনার পিণ্ড লইয়া বারের উপর ছ:ড়িয়া মারিতে লাগিল, কোনো ফল হইল না। মৃত্যুঞ্জয়ের বকে দমিয়া গেল— তবে আর কি সন্ন্যাসী আসিবে না! এই সবণকারাগারের মধ্যে তিলে তিলে পলে পলে শুকাইয়া মরিতে হইবে! তখন সোনাগলোকে দেখিয়া তাহার আতঙ্ক হইতে লাগিল। বিভীষিকার নিঃশব্দ কঠিন হাস্যের মতো ঐ সোনার সতপ চারি দিকে স্থির হইয়া রহিয়াছে— তাহার মধ্যে পন্দন নাই, পরিবতন নাই—মৃত্যুঞ্জয়ের যে হাদয় এখন কাঁপিতেছে, ব্যাকুল হইতেছে, তাহার সঙ্গে উহাদের কোনো সম্পক নাই, বেদনার কোনো সম্ববন্ধ নাই। এই সোনার পিন্ডগলো আলোক চায় না, আকাশ চায় না, বাতাস চায় না, প্রাণ চায় না, মুক্তি চায় না। ইহারা এই চির-অন্ধকারের মধ্যে চিরদিন উক্তজবল হইয়া, কঠিন হইয়া, পিথর হইয়া রহিয়াছে। পৃথিবীতে এখন কি গোধলি আসিয়াছে। আহা, সেই গোধলির সবণ ! যে সবণ কেবল ক্ষণকালের জন্য চোখ জড়াইয়া অন্ধকারের প্রান্তে কাঁদিয়া বিদায় লইয়া যায়। তাহার পরে কুটিরের প্রাঙ্গণতলে সন্ধ্যাতারা একদণ্টে চাহিয়া থাকে। গোঠে প্রদীপ জালাইয়া বধ ঘরের কোণে সন্ধ্যাদীপ স্থাপন করে। মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজিয়া উঠে। গ্রামের ঘরের অতি ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম ব্যাপার আজ মৃত্যুঞ্জয়ের কল্পনাদটির কাছে উজ্জবল হইয়া উঠিল। তাহাদের সেই যে ভোলা কুকুরটা লেজে মাথায় এক হইয়া উঠানের প্রান্তে সন্ধ্যার পর ঘনমাইতে থাকিত, সে কল্পনাও তাহাকে যেন ব্যথিত করিতে লাগিল। ধারাগোল গ্রামে কয়দিন সে যে মদির দোকানে আশ্রয় লইয়াছিল সেই মাদি এতক্ষণ রাত্রে প্রদীপ নিবাইয়া, দোকানে ঝাঁপ বন্ধ করিয়া, ধীরে ধীরে গ্রামে বাড়িমখে আহার করিতে চলিয়াছে, এই কথা স্মরণ করিয়া তাহার মনে হইতে লাগিল, মদি কী সদখেই আছে। আজ কী বার কে জানে। যদি রবিবার হয় তবে এতক্ষণে হাটের লোক যে যার আপন আপন বাড়ি ফিরিতেছে, সঙ্গচ্যুত সাথিকে উধাবরে ডাক পাড়িতেছে, দল বধিয়া খেয়ানৌকায় পার হইতেছে; মেঠো রাস্তা ধরিয়া, শস্যক্ষেত্রের আল বাহিয়া, পল্লীর শাকবংশপত্ৰখচিত অঙ্গনপাব দিয়া চাষি-লোক হাতে দটোএকটা মাছ ঝালাইয়া মাথায় একটা চুপড়ি লইয়া অন্ধকারে আকাশ-ভরা তারার ক্ষীণা