পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মাস্টারমশায় C: স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, তুই যেন বউ আনিতে চলিয়াছিস। ভোরের স্বপন কি মিথ্যা হইবে।” * হরলাল হাসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। টাকা ও নোটের থলেগলা লোহার সিন্দকে হইতে বাহির ভরয়া প্যাকবাক্সয় বন্ধ করিবার জন্য উদযোগ করিতে লাগিল। হঠাৎ তাহার বকের ভিতর ধড়াস করিয়া উঠিল— দুই-তিনটা নোটের থলি শান্য মনে হইল স্বপন দেখিতেছে। থলেগলা লইয়া সিন্দকের গায়ে জোরে আছাড় দিল— তাহাতে শান্য থলের শুন্যতা অপ্রমাণ হইল না। তব ব্যথা আশায় থলের বন্ধনগলা খলিয়া খুব করিয়া ঝাড়া দিল, একটি থলের ভিতর হইতে দইখানি চিঠি বাহির হইয়া পড়িল। বেপরে হাতের লেখা— একটি চিঠি তাহার বাপের নামে, আর একটি হরলালের । তাড়াতাড়ি খলিয়া পড়িতে গেল। চোখে যেন দেখিতে পাইল না। মনে হইল, যেন আলো যথেষ্ট নাই। কেবলই বাতি উসকাইয়া দিতে লাগিল। যাহা পড়ে তাহা ভালো বোঝে না, বাংলা ভাষা যেন ভুলিয়া গেছে। কথাটা এই যে, বেণ তিন হাজার টাকার পরিমাণ দশটাকাওয়ালা নোট লইয়া বিলাতে যাত্রা করিয়াছে, আজ ভোরেই জাহাজ ছাড়িবার কথা । হরলাল যে-সময় খাইতে গিয়াছিল সেই সময় বেণ এই কাণ্ড করিয়াছে। লিখিয়াছে যে, “বাবাকে চিঠি দিলাম, তিনি আমার এই ঋণ শোধ করিয়া দিবেন। তা ছাড়া ব্যাগ খুলিয়া দেখিবেন তাহ মধ্যে মায়ের যে গহনা আছে তাহার দাম কত ঠিক জানি না, বোধ হয় তিন হাজার টাকার বেশি হইবে । মা যদি বাঁচিয়া থাকিতেন তবে বাবা আমাকে বিলাতে যাইবার টাকা না দিলেও এই গহনা দিয়াই নিশ্চয় মা আমাকে খরচ জোগাড় করিয়া দিতেন । আমার ময়ের গহনা বাবা যে আর-কাহাকেও দিবেন তাহা আমি সহ্য করিতে পারি নাই। সেইজন্য যেমন করিয়া পারি আমিই তাহ লইয়াছি। বাবা যদি টাকা দিতে দেরি করেন তলে আপনি অনায়াসে এই গহনা বেচিয়া বা বন্ধক দিয়া টাকা লইতে পরিবেন। এ আমার মায়ের জিনিস—এ আমারই জিনিস।” এ ছাড়া আরো অনেক কথা— সে কোনো কাজের কথা নহে । হরলাল ঘলে তালা দিয়া তাড়াতাড়ি একখানা গাড়ি লইয়া গঙ্গার ঘাটে ছটিল। কোন জাহাজে বেণ যাত্রা করিয়াছে তাহার নামও সে জানে না। মেটিয়াবরেজ পর্যন্ত ছটিয়া হরলাল খবর পাইল দইখানা জাহাজ ভোরে রওনা হইয়া গেছে। দখোনই ইংলন্ডে যাইবে । কোন জাহাজে বেশ আছে তাহাও তাহার অনমানের অতীত এবং সে জাহাজ ধরিবার যে কণী উপায় তাহাও সে ভাবিয়া পাইল না। রৌদ্রে কলিকাতা শহর জাগিয়া উঠিয়াছে। হরলালের চোখে কিছুই পড়িল না। তাহার সমস্ত হতবধি অন্তঃকরণ একটা কলেবরহীন নিদারণে প্রতিকলতাকে যেন কেবলই প্রাণপণে ঠেলা মারিতেছিল—কিন্তু কোথাও এক তিলও তাহাকে টলাইতে পারিতেছিল না। যে বাসায় তাহার মা থাকেন, এতদিন যে বাসায় পা দিবামার কমক্ষেত্রের সমস্ত ক্লান্তি ও সংঘাতের বেদনা মহেতের মধ্যেই তাহার দরে হইয়া গিয়াছে, সেই বাসার সম্মুখে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল–গাড়োয়ানের ভাড়া চুকাইয়া দিয়া সেই বাসার মধ্যে সে অপরিমেয় নৈরাশ্য ও ভয় লইয়া প্রবেশ করিল।