পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

色ビミ গল্পগুচ্ছ অন্ধকার দিকে দিকে তাহার সহস্র করে চক্ষ মেলিয়া শিকারলদ্ধ দানবের মতো চুপ করিয়া রহিল। রাত্রি কত হইল সে কথা হরলাল চিন্তাও করিল না। তাহার কপালের শিরা দব দব করিতেছে; মাথা যেন ফাটিয়া যাইতেছে; সমস্ত শরীরে আগন জনলিতেছে; পা আর চলে না। সমস্ত দিন পৰ্যায়ক্ৰমে বেদনার উত্তেজনা ও অবসাদের অসাড়তার মধ্যে মার কথা কেবল মনের মধ্যে যাতায়াত করিয়াছে— কলিকাতার অসংখ্য জনশ্রেণীর মধ্যে কেবল ঐ একটিমাত্র নামই শাকক-ঠ ভেদ করিয়া মুখে উঠিয়াছে— মা, মা, মা। আর-কাহাকেও ডাকিবার নাই। মনে করিল, রাত্রি যখন নিবিড় হইয়া আসিবে, কোনো লোকই যখন এই অতিসামান্য হরলালকে বিনা অপরাধে অপমান করিবার জন্য জাগিয়া থাকিবে না, তখন সে চুপ করিয়া তাহার মায়ের কোলের কাছে গিয়া শ্যইয়া পড়িবে— তাহার পরে ঘমে যেন আর না ভাঙে ! পাছে তার মার সম্মুখে পলিসের লোক বা আর-কেহ তাহাকে অপমান করিতে আসে এই ভয়ে সে বাসায় যাইতে পারিতেছিল না। শরীরের ভার যখন আর বহিতে পারে না এমনসময় হরলাল একটা ভাড়াটে গাড়ি দেখিয়া তাহাকে ডাকিল। গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে।” হরলাল কহিল, “কোথাও না। এই ময়দানের রাস্তায় খানিকক্ষণ হাওয়া খাইয়া বেড়াইব ।” গাড়োয়ান সন্দেহ করিয়া চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিতেই হরলাল তাহার হাতে আগাম ভাড়া একটা টাকা দিল। সে গাড়ি তখন হরলালকে লইয়া ময়দানের রাস্তায় ঘরিয়া ঘরিয়া বেড়াইতে লাগিল। তখন শ্রান্ত হরলাল তাহার তপত মাথা খোলা জ্ঞানলার উপর রাখিয়া চোখ বাজিল। একটু একটা করিয়া তাহার সমস্ত বেদনা যেন দরে হইয়া আসিল । শরীর শীতল হইল। মনের মধ্যে একটি সুগভীর সুনিবিড় আনন্দপণ শান্তি ঘনাইয়া আসিতে লাগিল। একটা যেন পরম পরিত্রাণ তাহাকে চারি দিক হইতে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল। সে যে সমস্ত দিন মনে করিয়াছিল, কোথাও তাহার কোনো পথ নাই, সহায় নাই, নিম্প্রকৃতি নাই, তাহার অপমানের শেষ নাই, দুঃখের অবধি নাই, সে কথাটা যেন এক মহেতেই মিথ্যা হইয়া গেল। এখন মনে হইল, সে তো একটা ভয় মাত্র, সে তো সত্য নয়। যাহা তাহার জীবনকে লোহার মুঠিতে অটিয়া পিষিয়া ধরিয়াছিল, হরলাল তাহাকে আর কিছুমাত্র স্বীকার করিল না— মন্তি অনন্ত আকাশ পণ করিয়া আছে, শান্তির কোথাও সীমা নাই। এই অতিসামান্য হরলালকে বেদনার মধ্যে, অপমানের মধ্যে, অন্যায়ের মধ্যে, বন্দী করিয়া রাখতে পারে এমন শক্তি বিশ্বব্রহমান্ডের কোনো রাজা-মহারাজারও নাই। যে আতঙ্কে সে আপনাকে আপনি বধিয়াছিল তাহা সমস্তই খালিয়া গেল। তখন হরলাল আপনার বন্ধনমন্ত হাদয়ের চারি দিকে অনন্ত আকাশের মধ্যে অনুভব করিতে লাগিল, যেন তাহার সেই দরিদ্র মা দেখিতে দেখিতে বাড়িতে বাড়িতে বিরাটরপে সমস্ত অন্ধকার জড়িয়া বসিতেছেন। তাঁহাকে কোথাও ধরিতেছে না। কলিকাতার রাস্তাঘাট বাড়িঘর দোকানবাজার একট একটা করিয়া তাহার মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া লতে হইয়া যাইতেছে— বাতাস ভরিয়া গেল, আকাশ ভরিয়া উঠিল, একটি একটি করিয়া নক্ষত্র তাঁহার মধ্যে মিলাইয়া গেল— হরলালের শরীরমনের সমস্ত বেদনা, সমস্ত ভাবনা, সমস্ত চেতনা, তাঁহার মধ্যে অলপ অলপ করিয়া