পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাসমণির ছেলে d%۵ د হার মানিতে হইল, কিন্তু মন হইতে তাঁহার বিরুদ্ধতা ঘনচিল না। এ ঘরের ছেলে দোলাই মুড়ি দিয়া গড়মড়ি খায়, এমন বিসদৃশ দশ্য দিনের পর দিন কি দেখা যায়। পজার সময় তাঁহার মনে পড়ে, কতাঁদের আমলে নতন সাজসজা পরিয়া তাঁহারা কিরুপ উৎসাহ বোধ করিয়াছেন। পাজার দিনে রাসমণি কালীপদর জন্য যে সন্তা কাপড়-জামার ব্যবস্থা করিয়াছেন সাবেক কালে তাঁহাদের বাড়ির ভূত্যেরাও তাহাতে আপত্তি করিত। রাসমণি স্বামীকে অনেক করিয়া বঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, "কালীপদকে যাহা দেওয়া যায় তাহাতেই সে খুশি হয়, সে তো সাবেক দস্তুরের কথা কিছ জানে না—তুমি কেন মিছামিছি মন ভার করিয়া থাক।” কিন্তু, ভবানীচরণ কিছুতেই ভুলিতে পারেন না যে, বেচারা কালীপদ আপন বংশের গৌরব জানে না বলিয়া তাহাকে ঠকানো হইতেছে। বস্তুত সামান্য উপহার পাইয়া সে যখন গবেঃ ও আনন্দে নত্য করিতে করিতে তাঁহাকে ছটিয়া দেখাইতে আসে তখন তাহাতেই ভবানীচরণকে যেন আরও আঘাত করিতে থাকে। তিনি সে কিছুতেই দেখিতে পারেন না। তাঁহাকে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যাইতে হয় । ভবানীচরণের মকদ্দমা চালাইবার পর হইতে তাঁহাদের গরেক্টাকুরের ঘরে বেশ কিঞ্চিৎ অথীসমাগম হইয়াছে। তাহাতেই সন্তুষ্ট না থাকিয়া গ্রপত্রটি প্রতি বৎসর পজার কিছু পাবে কলিকাতা হইতে নানাপ্রকার চোখ-ভোলানো সস্তা শৌখিন জিনিস আনাইয়া কয়েক মাসের জন্য ব্যাবসা চালাইয়া থাকেন। অদশ্য কালি, ছিপ ছড়ি ছাতার একত্র সমবায়, ছবি-অাঁকা চিঠির কাগজ, নিলামে-কেনা নানা রঙের পচা রেশম ও সাটিনের থান, কবিতা-লেখা-পাড়-ওয়ালা শাড়ি প্রভৃতি লইয়া তিনি গ্রামের নরনারীর মন উতলা করিয়া দেন। কলিকাতার বাবমহলে আজকাল এই-সমস্ত উপকরণ না হইলে ভদ্রতা রক্ষা হয় না শুনিয়া গ্রামের উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিমান্তই আপনার গ্রামাতা ঘুচাইবার জন্য সাধ্যাতিরিক্ত বায় করিতে ছাড়েন না। একবার বগলাচরণ একটা অত্যাশ্চর্য মেমের মতি আনিয়াছিলেন। তার কোনএক জায়গায় দম দিলে মেম চৌকি ছাড়িয়া উঠিষা দাঁড়াইয়া প্রবল বেগে নিজেকে পাখা করিতে থাকে। এই বীজনপরায়ণ গ্রীষ্মকাতর মেমমতিটির প্রতি কালীপদর অত্যন্ত লোভ জন্মিল। কালীপদ তাহার মাকে বেশ চেনে, এইজন্য মার কাছে কিছু না বলিয়া ভবানীচরণের কাছে করণকণ্ঠে আবেদন উপস্থিত করিল। ভবানীচরণ তখনই উদারভাবে তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন, কিন্তু তাহার দাম শুনিয়া তাঁহার মাখ শকাইয়া গেল। টাকাকড়ি আদায়ও করেন রাসমণি, তহবিলও তাঁহার কাছে, খরচও তাঁহার হাত দিয়াই হয়। ভবানীচরণ ভিখারির মতো তাঁহার অন্নপশোর বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন । প্রথমে বিস্তর অপ্রাসঙ্গিক কথা আলোচনা করিয়া অবশেষে এক সময়ে ধাঁ করিয়া আপনার মনের ইচ্ছাটা বলিয়া ফেলিলেন। রাসমণি অত্যন্ত সংক্ষেপে বলিলেন, “পাগল হইয়াছ!” ভবানীচরণ চুপ করিয়া খানিকক্ষণ ভাবিতে লাগিলেন। তাহার পরে হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “আচ্ছা দেখো, ভাতের সঙ্গে তুমি যে রোজ আমাকে ঘি আর পায়স দাও, সেটার তো প্রয়োজন নাই!”