পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(&న8 গল্পগুচ্ছ তখন পাড়ার এক বাড়িতে পরীক্ষা করিয়া উৎসবের বাঁশির বায়না করা হইতেছিল। সেই রসনচোঁকিতে সকালবেলাকার করণ সরে শরতের নবীন রৌদ্র যেন প্রচ্ছন্ন অশ্রভারে ব্যথিত হইয়া উঠিতেছিল। কালীপদ তাহাদের বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়াইয়া চুপ করিয়া পথের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পিতা যে কোনো কাজেই কোথাও যাইতেছেন না, তাহা তাঁহার গতি দেখিয়াই বুঝা যায়—প্রতি পদক্ষেপেই তিনি যে একটা নৈরাশ্যের বোঝা টানিয়া টানিয়া চলিয়াছেন এবং তাহা কোথাও ফেলিবার স্থান নাই, তাহা তাঁহার পশ্চাৎ হইতেও পষ্ট দেখা যাইতেছিল। কালীপদ অন্তঃপরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “মা, আমার সেই পাখা-করা মেম চাই না।” মা তখন জাতি লইয়া ক্ষিপ্রহস্তে সপোরি কাটিতেছিলেন। তাঁহার মাখ উজ্জল হইয়া উঠিল। ছেলেতে মায়েতে সেইখানে বসিয়া কী একটা পরামশ হইয়া গেল তাহা কেহই জানিতে পারিল না। জাতি রাখিয়া ধামা-ভরা কাটা ও অকাটা সুপরি ফেলিয়া রাসমণি তখনই বগলাচরণের বাড়ি চলিয়া গেলেন । আজ ভবানীচরণের বাড়ি ফিরিতে অনেক বেলা হইল। স্নান সারিয়া যখন তিনি খাইতে বসিলেন তখন তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, আজও দধিপায়সের সদগতি হইবে না, এমন-কি মাছের মড়াটা আজ সম্পণেই বিড়ালের ভোগে লাগিবে। তখন দড়ি দিয়া মোড়া কাগজের এক বাক্স লইয়া রাসমণি তাঁহার স্বামীর সম্মুখে আনিয়া উপসিথত করিলেন । আহারের পরে যখন ভবানীচরণ বিশ্রাম করিতে যাইবেন তখনই এই রহস্যটা তিনি আবিস্কার করিবেন, ইহাই রাসমণির ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দধি পায়স ও মাছের মডার অনাদর দুর করিবার জন্য এখনই এটা বাহির করিতে হইল। বাক্সের ভিতর হইতে সেই মেম-মতি বাহির হইয়া বিনা বিলম্বে প্রবল উৎসাহে আপন গ্রীষ্মমতাপ-নিবারণে লাগিয়া গেল। বিড়ালকে আঞ্জ হতাশ হইয়া ফিরিতে হইল। ভবানীচরণ গহিণীকে বলিলেন, “আজ রান্নাটা বড়ো উত্তম হইয়াছে। অনেকদিন এমন মাছের ঝোল খাই নাই। আর, দইটা যে কী চমৎকার ভুমিয়াছে সে আর কী বলিব ।” সপ্তমীর দিন কালীপদ তাহার অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষার ধন পাইল । সেদিন সমস্ত দিন সে মেমের পাখা-খাওয়া দেখিল, তাহার সমবয়সী বন্ধবোন্ধবদিগকে দেখাইয়া তাহাদের ঈর্ষার উদ্রেক করিল। অন্য কোনো অবপথায় হইলে সমস্তক্ষণ এই পর্তুলের একঘেয়ে পাখা-নাড়ায় সে নিশ্চয়ই এক দিনেই বিরক্ত হইয়া যাইত— কিন্তু অষ্টমীর দিনেই প্রতিমা বিসজন দিতে হইবে জানিয়া তাহার অনুরাগ আটল হইয়া রহিল। রাসমণি তাঁহার গবে পত্রকে দই টাকা নগদ দিয়া কেবল এক দিনের জন্য এই পর্তুলটি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলেন। অষ্টমীর দিনে কালীপদ দীঘ নিশ্বাস ফেলিয়া স্বহস্তে বাঙ্গসমেত পর্তুলটি বগলাচরণের কাছে ফিরাইয়া দিয়া আসিল । এই এক দিনের মিলনের সন্থসমতি অনেকদিন তাহার মনে জাগরকে হইয়া রহিল, তাহার কল্পনালোকে পাখা চলার আর বিরাম রহিল না। এখন হইতে কালীপদ মাতার মন্ত্রণার সংগী হইয়া উঠিল এবং এখন হইতে ভবানীচরণ প্রতিবৎসরই এত সহজে এমন মল্যেবান পঙ্গার উপহার কালীপদকে দিতে পারিতেন যে, তিনি নিজেই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন।