পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ج O بين গেল। তৎক্ষণাৎ বাক্সটার ডালা বন্ধ করিয়া, নোটখানা হতে লইয়াই তাহারা উপরে ছটিল। একজন তাড়াতাড়ি দরজায় তালা লাগাইয়া দিল । শৈলেন সেই নোটখানা দেখিয়া অত্যন্ত হাসিল। পঞ্চাশ টাকা শৈলেনের কাছে কিছুই নয়, তব এত টাকাও যে কালীপদর বাক্সে ছিল তাহা তাহার ব্যবহার দেখিয়া কেহ অনুমান করিতে পারিত না। তাহার পরে আবার এই নোটটুকুর জন্য এত সাবধান! সকলেই সিথর করিল, দেখা যাক এই টাকাটা খোয়া গিয়া এই অদ্ভুত লোকটি কিরকম কান্ডটা করে। রাত্ৰি নটার পর ছেলে পড়াইয়া শ্রান্তদেহে কালীপদ ঘরের অবস্থা কিছই লক্ষ্য করে নাই। বিশেষত, মাথা তাহার যেন ছিড়িয়া পড়িতেছিল। বুঝিয়াছিল, এখন কিছুদিন তাহার এই মাথার যন্ত্রণা চলিবে । পরদিন সে কাপড় বাহির করিবার জন্য তক্তাপোশের নীচে হইতে টিনের বাক্সটা টানিয়া দেখিল বাক্সটা খোলা। যদিচ কালীপদ স্বভাবত অসাবধান নয় তব তাহার মনে হইল, হয়তো সে চাবি বন্ধ করিতে ভুলিযা গিয়াছিল। কারণ, ঘরে যদি চোর আসিত তবে বাহিরের দবতা তালা বন্ধ থাকিত না । বাক্স খলিয়া দেখে, তাহার কাপড়-চোপড় সমস্ত উলট-পালট। তাহার লকে দমিয়া গেল। তাড়াতাড়ি সমস্ত জিনিসপত্র বাহির করিয়া দেখিল, তাহার সেই মাতৃদত্ত নোটখানি নাই। কাগজ ও কাপড়ের মোড়কগুলা আছে। বার বার করিয়া কালীপদ সমস্ত কাপড় সবলে ঝাড়া দিতে লাগিল, নোট বাহির হইল না। এ দিকে উপরের তলার দই-একটি করিযা লোক যেন আপনার কাজে সিড়ি দিয়া নামিয়া সেই ঘরটার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বারবার উঠানামা করিতে লাগিল । উপরে অট্টহাস্যের ফোয়ারা খুলিয়া গেল। যখন নোটের কোনো আশাই রহিল না এবং মাথার কন্টে যখন জিনিসপত্র নাড়ানাড়ি করা তাহার পক্ষে আর সম্ভবপর হইল না তখন সে বিছানার উপর উপড়ে হইয়া মন্তদেহের মতো পড়িয়া রহিল। এই তাহার মাতার অনেক দুঃখের নোটখানি— জীবনের কত মহেতেকে কঠিন যন্তে পেষণ করিষা দিনে দিনে একট একট করিয়া এই নোটখানি সঞ্চিত হইয়াছে। একদা এই দুঃখের ইতিহাস সে কিছুই জানিত না, সেদিন সে তাহার মাতার ভারের উপর ভার কেবল বাড়াইয়াছে, অবশেষে যেদিন মা তাহাকে তাঁহার প্রতিদিনের নিয়ত-আবর্তমান দুঃখের সঙ্গী করিয়া লইলেন সেদিনকার মতো এমন গৌরব সে তাহার বয়সে আর-কখনো ভোগ করে নাই। কালীপদ আপনার জীবনে সব-চেয়ে যে বড়ো বাণী, যে মহত্তম আশীবাদ পাইয়াছে এই নোটখানির মধ্যে তাহাই পাণ’ হইয়া ছিল। সেই তাহার মাতার অতলপশ স্নেহসমুদ্ৰ-মন্থন-করা অমল্য দুঃখের উপহারটুকু চুরি যাওয়াকে সে একটা পৈশাচিক অভিশাপের ষড়া মনে করিল। পাশের সিড়ির উপর দিয়া পায়ের শব্দ আজ বারবার শোনা যাইতে লাগিল। অকারণ ওঠা এবং নামার আজ আর বিরাম নাই। গ্রামে আগন লাগিয়া পড়িয়া ছাই হইয়া যাইতেছে, আর ঠিক তাহার পাশ দিয়াই কৌতুকের কলশব্দে নদী অবিরত ছটিয়া চলিয়াছে – এও সেইরকম । উপরের তলায় অট্টহাস্য শুনিয়া এক সময়ে কালীপদর হঠাৎ মনে হইল, এ চোরের কাজ নয়। এক মহতে সে বঝিতে পারিল, শৈলেন্দ্রের দল কৌতুক করিয়া