পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SO 8 গল্পগুচ্ছ তিনবার ডাকিল, “কালীপদবাব!” কেহ কোনো সাড়া দিল না। কেবল সেই বিড় বিড় বকুনি চলিতে লাগিল। শৈলেন পনশ্চ উচ্চস্বরে কহিল, "কালীপদবাব, দরজা খলন, আপনার সেই নোট পাওয়া গেছে।" দরজা খলিল না, কেবল বকুনির গঞ্জনধ্বনি শোনা গেল। ব্যাপারটা যে এতদর গড়াইবে তাহা শৈলেন কল্পনাও করে নাই। সে মুখে তাহার অনুচরদের কাছে অনন্তাপবাক্য প্রকাশ করিল না। কিন্তু, তাহার মনের মধ্যে বিধিতে লাগিল। সে বলিল, “দরজা ভাঙিয়া ফেলা যাক।” কেহ কেহ পরামর্শ দিল, “পলিস ডাকিয়া আনো— কী জানি পাগল হইয়া যদি হঠাৎ কিছু করিয়া বসে— কাল যেরকম কান্ড দেখিয়াছি— সাহস হয় না।” শৈলেন কহিল, “না— শীঘ্র একজন গিয়া অনাদি ডাক্তারকে ডাকিয়া আনো।” অনাদি ডাক্তার বাড়ির কাছেই থাকেন। তিনি আসিয়া দরজায় কান দিয়া বলিলেন, “এ তো বিকার বলিয়াই বোধ হয়।" দরজা ভাঙিয়া ভিতরে গিয়া দেখা গেল— তত্ত্বাপোশের উপর এলোমেলো বিছানা খানিকটা ভ্ৰষ্ট হইয়া মাটিতে লটাইতেছে। কালীপদ মেজের উপর পড়িয়া—তাহার চেতনা নাই। সে গড়াইতেছে, ক্ষণে ক্ষণে হাত-পা ছড়িতেছে এবং প্রলাপ বকিতেছে ; তাহার রক্তবর্ণ চোখদটা খোলা এবং তাহার মুখে যেন রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে। ডাক্তার তাহার পাশে বসিয়া অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিয়া শৈলেনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহার আত্মীয় কেহ আছে ?” শৈলেনের মুখ বিবণ হইয়া গেল। সে ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বলন দেখি ।” ডাক্তার গভীর হইয়া কহিলেন, "খবর দেওয়া ভালো, লক্ষণ ভালো নয়।” শৈলেন কহিল, “ইহাদের সঙ্গে আমাদের ভালো আলাপ নাই— আত্মীয়ের খবর কিছুই জানি না। সন্ধান করিব। কিন্তু, ইতিমধ্যে কী করা কতব্য ।” ডাক্তার কহিলেন, “এ ঘর হইতে রোগীকে এখনই দোতলার কোনো ভালো ঘর লইয়া যাওয়া উচিত। দিনরাত শশ্রেষার ব্যবস্থা করাও চাই।” শৈলেন রোগীকে তাহার নিজের ঘরে লইয়া গেল। তাহার সহচরদের সকলকে ভিড় করিতে নিষেধ করিয়া ঘর হইতে বিদায় করিয়া দিল। কালীপদর মাথায় বরফের পটালি লাগাইয়া নিজের হাতে বাতাস করিতে লাগিল। পবেই বলিয়াছি, এই বাড়ির উপরতলার দলে পাছে কোনোপ্রকার অবজ্ঞা বা পরিহাস করে এইজন্য নিজের পিতামাতার সকল পরিচয় কালীপদ ইহাদের নিকট হইতে গোপন করিয়া চলিয়াছে। নিজে তাঁহাদের নামে যে চিঠি লিখিত তাহা সাবধানে ডাকঘরে দিয়া আসিত এবং ডাকঘরের ঠিকানাতেই তাহার নামে চিঠি আসিত— প্রত্যহ সে নিজে গিয়া তাহা সংগ্ৰহ করিয়া আনিত । কালীপদর বাড়ির পরিচয় লইবার জন্য আর-একবার তাহার বাক্স খলিতে হইল। তাহার বাক্সের মধ্যে দই তাড়া চিঠি ছিল। প্রত্যেক তাড়াটি অতিযত্নে ফিতা দিয়া বাঁধা। একটি তাড়াতে তাহার মাতার চিঠি, আর-একটিতে তাহার পিতার। মায়ের চিঠি সংখ্যায় অল্পই পিতার চিঠিই বেশি। 嗜 চিঠিগুলি হাতে করিয়া আনিয়া শৈলেন দরজা বন্ধ করিয়া দিল এবং রোগীর