পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6.8 গল্পগুচ্ছ লাগিল, যেন অনেক দর হইতে, পথিবীর অতলপশ হইতে, একটা ক্ৰন্দনধনি উঠিতেছে। মনে হইল, যেন রাত্রির আকাশ সেই একমাত্র শব্দে পরিপণ হইয়া উঠিতেছে, পথিবীর সমস্ত নিদ্রিত লোক যেন সেই শব্দে শয্যার উপরে জাগিয়া উঠিয়া কান পাতিয়া বসিয়া আছে। বন্ধ অস্থির হইয়া কেবলই মাটির উপরে মাটি চাপাইতেছে। যেন এমনি করিয়া কোনোমতে পৃথিবীর মুখ চাপা দিতে চাহে। ওই কে ডাকে “বাবা"। বন্ধ মাটিতে আঘাত করিয়া বলে, "চুপ কর । সবাই শুনিতে পাইবে।” আবার কে ডাকে “বাবা”। দেখিল রৌদ্র উঠিয়াছে। ভয়ে মন্দির ছাড়িয়া মাঠে বাহির হইয়া পড়িল । সেখানেও কে ডাকিল, “বাবা।” যজ্ঞনাথ সচকিত হইয়া পিছন ফিরিয়া দেখিলেন, বন্দোবন । বান্দাবন কহিল, “বাবা, সন্ধান পাইলাম আমার ছেলে তোমার ঘরে লুকাইয়া আছে । তাহাকে দাও।” বন্ধ চোখমুখ বিকৃত করিয়া বন্দাবনের উপর ঝ:কিয়া পড়িয়া বলিল, “তোর ছেলে ?” বন্দাবন কহিল, "হাঁ, গোকুল-- এখন তাহার নাম নিতাই পাল, আমার নাম দামোদর। কাছাকাছি সবত্রই তোমার খ্যাতি আছে, সেইজন্য আমরা লক্ষজায় নাম পরিবতন করিয়াছি; নহিলে কেহ আমাদের নাম উচ্চারণ করিত না।” বন্ধ দশ অঙ্গলি বারা আকাশ হাংড়াইতে হাংড়াইতে যেন বাতাস অাঁকড়িয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। চেতনা লাভ করিয়া যজ্ঞনাথ বন্দোবনকে মন্দিরে টানিয়া লইয়া গেলেন। কহিলেন, “কান্না শুনিতে পাইতেছ?” বন্দোবন কহিল, “না।” “কান পাতিয়া শোনো দেখি, বাবা বলিয়া কেহ ভাকিতেছে ?” বন্দাবন কহিল, “না।” বন্ধ তখন যেন ভারি নিশিচন্ত হইল। তাহার পর হইতে বন্ধ সকলকে জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়ায়, “কান্না শুনিতে পাইতেছ?” পাগলামির কথা শুনিয়া সকলেই হাসে। অবশেষে বৎসর-চারেক পরে বন্ধের মৃত্যুর দিন উপস্থিত হইল। যখন চোখের উপর হইতে জগতের আলো নিবিয়া আসিল এবং বাস রন্ধপ্রায় হইল তখন লিকারের বেগে সহসা উঠিয়া বসিল; একবার দই হতে চারি দিক হাংড়াইয়া মন্মষে কহিল, “নিতাই, আমার মইটা কে উঠিয়ে নিলে।” সেই বায়হেীন আলোকহীন মহাগহর হইতে উঠিবার মই খ:জিয়া না পাইয়া আবার সে ধাপ করিয়া বিছানায় পড়িয়া গেল। সংসারের লকোচুরি খেলায় যেখানে কাহাকেও খুজিয়া পাওয়া যায় না সেইখানে অন্তহিত হইল। পৌষ ১২৯৮