পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হৈমন্তী も●。 সংসার চলে, কিন্তু পনেরো-আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে সাঁকে বিবাহমাত্র করে, পায় না, এবং জানেও না যে পায় নাই; তাহদের পল্লীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু, সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ। শিশির—না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না। একে তো এটা তাহার নাম নয়, তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও নহে। সে সবের মতো খুব; সে ক্ষশজীবনী উষার বিদায়ের আশ্রমবিন্দটি নয়। কী হইবে গোপনে রাখিয়া। তাহার আসল নাম হৈমন্তী। দেখিলাম, এই সতেরো বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলো অসিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এখনো কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই। ঠিক যেন শৈলচড়ার বরফের উপর সকালের আলো ঠিকরিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু বরফ এখনো গলিল না। আমি জানি, কী অকলঙ্ক শত্র সে, কী নিবিড় পবিত্র । আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে, লেখাপড়া-জানা বড়ো মেয়ে, কী জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে। কিন্তু, অতি অলপ দিনেই দেখিলাম, মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের দোকানের রাস্তার কোনো জায়গায় কোনো কাটাকাটি নাই । কবে যে তাহার সাদা মনটির উপরে একটা রঙ ধরিল, চোখে একটা ঘোর লাগিল, কবে যে তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসকে হইয়া উঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এ তো গেল এক দিকের কথা । আবার অন্য দিকও আছে, সেটা বিস্তারিত বলিবার সময় আসিয়াছে । রাজসংসারে আমার বশরের চাকরি। ব্যাকে যে তাঁহার কত টাকা জমিল সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানা প্রকার অঙ্কপাত করিয়াছে, কিন্তু কোনো অঙ্কটাই লাখের নীচে নামে নাই। ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, তাহার পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল হৈমর আদরও তেমনি বাড়িতে থাকিল। আমাদের ঘরের কাজকম রীতিপদ্ধতি শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যগ্র, কিন্তু মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই হাত দিতে দিলেন না। এমন-কি, হৈমর সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের ঘরে ঢাকিতে দিতেন না তব, তাহার জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না, পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শনিতে হয়। এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পারিত, কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবার মুখ ঘোর অন্ধকার দেখা গেল। ব্যাপারখানা এই— আমার বিবাহে আমরা বশরে পনেরো হাজার টাকা নগদ এবং পাঁচ হাজার টাকার গহনা দিয়াছিলেন। বাবা তাঁহার এক দালাল বন্ধর কাছে খবর পাইয়াছেন, ইহার মধ্যে পনেরো হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্ৰহ করিতে হইয়াছে, তাহার সদেও নিতান্ত সামান্য নহে। লাখ টাকার গজব তো একেবারেই ফাঁক। যদিও আমার বশরের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে তাঁহার কোনোদিন কোনো আলোচনাই হয় নাই, তব বাবা জানি না কোন যান্তিতে ঠিক করিলেন, তাঁহার বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপবেক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন।