পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७१ २ গল্পগুচ্ছ বলো— দেখলাম, তোমরা সকলেই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠেছ, সেইজন্যেই এই নিরাশ্রয় মেয়েটির পাশে আমার সমস্ত মন যেন একেবারে কোমর বেধে দাঁড়ালো। পরের বাড়িতে পরের অনিচ্ছাতে এসে আশ্রয় নেওয়া— সে কত বড়ো অপমান। দায়ে পড়ে সেও যাকে স্বীকার করতে হল তাকে কি এক পাশে ঠেলে রাখা যায়। তার পরে দেখলাম আমার বড়ো জায়ের দশা। তিনি নিতান্ত দরদে পড়ে বোনটিকে নিজের কাছে এনেছেন। কিন্তু, যখন দেখলেন স্বামীর অনিচ্ছা তখন এমনি ভাব করতে লাগলেন, যেন এ তাঁর এক বিষম বালাই, যেন একে দরে করতে পারলেই তিনি বাঁচেন। এই অনাথা বোনটিকে মন খালে প্রকাশ্যে স্নেহ দেখাবেন সে সাহস তাঁর হল না। তিনি পতিব্ৰতা । তাঁর এই সংকট দেখে আমার মন আরও ব্যথিত হয়ে উঠল। দেখলাম, বড়ো জা সকলকে একটা বিশেষ করে দেখিয়ে দেখিয়ে বিন্দর খাওয়াপরার এমনি মোটা রকমের ব্যবস্থা করলেন এবং বাড়ির সব প্রকার দাসীবত্তিতে তাকে এমনভাবে নিযন্তে করলেন যে আমার কেবল দুঃখ নয়, লজা বোধ হল। তিনি সকলের কাছে প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত যে, আমাদের সংসারে ফাঁকি দিয়ে বিন্দকে ভারি সুবিধাদরে পাওয়া গেছে। ও কাজ দেয় বিস্তর, অথচ খরচের হিসাবে বেজায় সস্তা। আমাদের বড়ো জায়ের বাপের বংশে কুল ছাড়া আর বড়ো কিছু ছিল না, রপেও না, টাকাও না। আমার শ্বশুরের হাতে পায়ে ধরে কেমন করে তোমাদের ঘরে তাঁর বিবাহ হল সে তো সমস্তই জান । তিনি নিজের বিবাহটাকে এ বংশের প্রতি বিষম একটা অপরাধ বলেই চিরকাল মনে জেনেছেন। সেইজন্যে সকল বিষয়েই নিজেকে যত দর সম্ভব সংকুচিত করে তোমাদের ঘরে তিনি অতি অলপ জায়গা জুড়ে থাকেন। কিন্তু, তাঁর এই সাধ দণ্টাতে আমাদের বড়ো মশকিল হয়েছে। আমি সকল দিকে আপনাকে অত অসম্পভব থাটো করতে পারি নে। আমি যেটাকে ভালো বলে বুঝি আর-কারও খাতিরে সেটাকে মন্দ বলে মেনে নেওয়া আমার কম নয়— তুমিও তার অনেক প্রমাণ পেয়েছ । বিন্দকে আমি আমার ঘরে টেনে নিলাম। দিদি বললেন, “মেজোবউ গরিবের ঘরের মেয়ের মাথাটি খেতে বসলেন।” আমি যেন বিষম একটা বিপদ ঘটালাম, এমনি ভাবে তিনি সকলের কাছে নালিশ করে বেড়ালেন। কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, তিনি মনে মনে বেচে গেলেন। এখন দোষের বোঝা আমার উপরেই পড়ল। তিনি বোনকে নিজে যে স্নেহ দেখাতে পারতেন না আমাকে দিয়ে সেই স্নেহটকু করিয়ে নিয়ে তাঁর মনটা হালকা হল। আমার বড়ো জা বিন্দর বয়স থেকে দু-চারটে অঙ্গক বাদ দিতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু, তার বয়স যে চোদর চেয়ে কম ছিল না, এ কথা লুকিয়ে বললে, অন্যায় হত না। তুমি তো জান, সে দেখতে এতই মন্দ ছিল যে, পড়ে গিয়ে সে যদি মাথা ভাঙত তবে ঘরের মেজেটর জন্যই লোকে উদবিগ্ন হত। কাজেই পিতা-মাতার অভাবে কেউ তাকে বিয়ে দেবার ছিল না, এবং তাকে বিয়ে করবার মতো মনের জোরই বা কজন লোকের ছিল। বিন্দ বড়ো ভয়ে ভরে আমার কাছে এল। যেন আমার গায়ে তার ছোঁয়াচ লাগলে আমি সইতে পারব না। বিশ্বসংসারে তার যেন জন্মাবার কোনো শত ছিল না; তাই সে কেবলই পাশ কাটিয়ে, চোখ এড়িয়ে চলত। তার বাপের বাড়িতে তার খড়ততো