পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ & too ভাইফোঁটা শ্রাবণ মাসটা আজ যেন এক রাত্রে একেবারে দেউলে হইয়া গেছে । সমস্ত আকাশে কোথাও একটা ছোড়া মেঘের টকেরাও নাই। আশচয এই যে, আমার সকালটা আজ এমন করিয়া কাটিতেছে। আমার বাগানের মেহেদি-বেড়ার প্রান্তে শিরীষগাছের পাতাগলা ঝলমল করিয়া উঠিতেছে, আমি তাহা তাকাইয়া দেখিতেছি। সবনাশের যে মাঝ-দরিয়ায় আসিয়া পেপছিয়াছি এটা যখন দরে ছিল তখন ইহার কথা কল্পনা করিয়া কত শীতের রাত্রে সবাঙ্গে ঘাম দিয়াছে, কত গ্রীমের দিনে হাত-পায়ের তেলো ঠাণ্ডা হিম হইয়া গেছে। কিন্তু, আজ সমস্ত ভয়ভাবনা হইতে এমনি ছয়টি পাইয়াছি যে, ঐ-যে আতাগাছের ডালে একটা গিরগিটি সিথর হইয়া শিকার লক্ষ্য করিতেছে সেটার দিকেও আমার চোখ রহিয়াছে। সবসব খোয়াইয়া পথে দাঁড়াইব, এটা তত কঠিন না— কিন্তু, আমাদের বংশে যে সততার খ্যাতি আজ তিন-পরিষে চলিয়া আসিয়াছে সেটা আমারই জীবনের উপর আছাড় খাইয়া চুরমার হইতে চলিল সেই লক্ষজাতেই আমার দিনরাত্রি স্বসিত ছিল না। এমন-কি আত্মহত্যার কথাও অনেকবার ভাবিয়াছি। কিন্তু, আজ যখন আর পদা রহিল না, খাতাপত্রের গৃহাগহর হইতে অখ্যাতিগুলো কালো কিমির মতো কিলবিল করিয়া বাহির হইয়া আদালত হইতে খবরের কাগজময় ছড়াইয়া পড়িল, তখন আমার একটা মস্ত বোঝা নামিয়া গেল। পিতৃপরিষের সনামটাকে টানিয়া বেড়াইবার দায় হইতে রক্ষা পাইলাম। সবাই জানিল, আমি জযোচোর। বাঁচা গেল। উকিলে উকিলে ছোড়াছিড়ি করিয়া সকল কথাই বাহির করিবে, কেবল সকলের চেয়ে বড়ো কলঙ্কের কথাটা আদালতে প্রকাশ হইবার সম্পভাবনা নাই— কারণ, স্বয়ং ধম ছাড়া তার আর-কোনো ফরিয়াদি অবশিস্ট নাই। এইজন্য সেইটে প্রকাশ করিয়া দিব বলিয়াই আজ কলম ধরিলাম । আমার পিতামহ উদ্ধব দত্ত তাঁর প্রভূবংশকে বিপদের দিনে নিজের সম্পত্তি দিয়া রক্ষা করিয়াছেন। সেই হইতে আমাদের দারিদ্র্যই অন্য লোকের ধনের চেয়ে মাথা উঁচু করিয়াছে। আমার পিতা সনাতন দত্ত ডিরোজিয়োর ছাত্র। মদের সম্বন্ধে তাঁর যেমন অদ্ভূত নেশা ছিল সত্যের সম্বন্ধে ততোধিক । মা আমাদের একদিন নাপিত-ভায়ার গল্প বলিয়াছিলেন শুনিয়া পরদিন হইতে সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়ির ভিতরে যাওয়া তিনি একেবারে বন্ধ করিয়া দিলেন। বাহিরে পড়বার ঘরে শইতাম। সেখানে দেয়াল জড়িয়া ম্যাপগলা সত্য কথা বলিত, তেপাতের মাঠের খবর দিত না, এবং সাত সমদ্র তেরো নদীর গল্পটাকে ফাঁসিকাঠে ঝালাইয়া রাখিত। সততা সম্বন্ধেও তাঁর শনচিবায় প্রবল ছিল। আমাদের জবাবদিহির অন্ত ছিল না। একদিন একজন ‘হকাব’ দাদাকে কিছু জিনিস বেচিয়াছিল। তারই কোনো-একটা মোড়কের একখানা দড়ি লইয়া খেলা করিতেছিলাম। বাবার হবুেমে সেই দাঁড় হকারকে ফিরাইয়া দিবার জন্য রাস্তায় আমাকে ছয়টিতে হইয়াছিল। আমরা সাধতার জেলখানায় সততার লোহার বেড়ি পরিয়া মানুষ। মানবে