পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ Ն, গল্পগুচ্ছ সে যে কী রঙের কাপড় কেমন করিয়া পরিয়াছিল তাহাও ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এটা খুব সত্য যে, তার বেশে ভূষায় এমন কিছই ছিল না যেটা তাহাকে ছাড়াইয়া বিশেষ করিয়া চোখে পড়িতে পারে। সে নিজের চারি দিকের সকলের চেয়ে অধিক—রজনীগন্ধার শত্র মঞ্জরীর মতো সরল বান্তটির উপরে দাঁড়াইয়া, যে গাছে ফটিয়াছে সে গাছকে সে একেবারে অতিক্ৰম করিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে দলটি-তিনটি ছোটো ছোটো মেয়ে ছিল, তাহাদিগকে লইয়া তাহার হাসি এবং কথার আর অন্ত ছিল না। আমি হাতে একখানা বই লইয়া সে দিকে কান পাতিয়া রাখিয়াছিলাম । যেটুকু কানে আসিতেছিল সে তো সমস্তই ছেলেমানষেদের সঙ্গে ছেলেমানষি কথা। তাহার বিশেষত্ব এই যে, তাহার মধ্যে বয়সের তফাত কিছলমাত্র ছিল না-- ছোটোদের সঙ্গে সে অনায়াসে এবং আনন্দে ছোটো হইয়া গিয়াছিল। সঙ্গে কতকগলি ছবিওয়ালা ছেলেদের গল্পের বই– তাহারই কোন-একটা বিশেষ গল্প শোনাইবার জন্য মেয়েরা তাহাকে ধরিয়া পড়িল । এ গলপ নিশ্চয় তারা বিশ-প“চিশ বার শনিয়াছে। মেয়েদের কেন যে এত আগ্রহ তাহা বুঝিলাম। সেই সন্ধাকঠের সোনার কাঠিতে সকল কথা ষে সোনা হইয়া ওঠে । মেয়েটির সমস্ত শরীর মন যে একেবারে প্রাণে ভরা, তার সমস্ত চলায় বলায় পশে প্রাণ ঠিকরিয়া ওঠে। তাই মেয়েরা যখন তার মুখে গল্প শোনে তখন, গল্প নয়, তাহাকেই শোনে ; তাহাদের হৃদয়ের উপর প্রাণের ঝন ঝরিয়া পড়ে। তার সেই উদ্ভাসিত প্রাণ আমার সেদিনকার সমস্ত সষকিরণকে সজীব করিয়া তুলিল ; আমার মনে হইল, আমাকে যে প্রকৃতি তাহার আকাশ দিয়া বেস্টন করিয়াছে সে ঐ তরণীরই অক্লান্ত অম্বলান প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিস্তার – পরের স্টেশনে পৌছিতেই খাবারওয়ালাকে ডাকিয়া সে খবে খানিকটা চানা-মঠে কিনিয়া লইল, এবং মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো করিয়া কলহাস্য করিতে করিতে অসংকোচে খাইতে লাগিল। আমার প্রকৃতি ষে জাল দিয়া বেড়া— আমি কেন বেশ সহজে হাসিমুখে মেয়েটির কাছে এই চানা একমঠা চাহিয়া লইতে পারিলাম না। হাত বাড়াইয়া দিয়া কেন আমার লোভ সবীকার করিলাম না। মা ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগার মধ্যে দোমনা হইয়া ছিলেন । গাড়িতে আমি পরষমানুষ, তব ইহার কিছুমাত্র সংকোচ নাই, বিশেষত এমন লোভীর মতো খাইতেছে, সেটা ঠিক তাঁর পছন্দ হইতেছিল না; অথচ ইহাকে বেহায়া বলিয়াও তাঁর ভ্রম হয় নাই। তাঁর মনে হইল, এ মেয়ের বয়স হইয়াছে কিন্তু শিক্ষা হয় নাই। মা হঠাৎ কারও সঙ্গে আলাপ করিতে পারেন না। মানুষের সঙ্গে দরে দরে থাকাই তাঁর অভ্যাস। এই মেয়েটির পরিচয় লইতে তাঁর খুব ইচ্ছা, কিন্তু স্বাভাবিক বাধা কাটাইয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। f এমন সময়ে গাড়ি একটা বড়ো স্টেশনে আসিয়া থামিল। সেই জেনারেল-সাহেবের একদল অনসঙ্গী এই স্টেশন হইতে উঠিবার উদযোগ করিতেছে। গাড়িতে কোথাও জায়গা নাই। বারবার আমাদের গাড়ির সামনে দিয়া তারা ঘরিয়া গেল। মা তো ভয়ে আড়ষ্ট, আমিও মনের মধ্যে শান্তি পাইতেছিলাম না। গাড়ি ছাড়িবার অল্পকাল-পাবে একজন দেশী রেলোয়ে কর্মচারী নাম-লেখা দইখানা টিকিট গাড়ির দুই বেঞ্চের শিয়রের কাছে লটকাইয়া দিয়া আমাকে বলিল,