পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aミ8 গল্পগুচ্ছ জটাধারীরা যখন আহার-আরামের অপরিহায্য কটি লইয়া গালি দেয়, অভিশাপ দিতে ওঠে, তখন এক-একদিন ইচ্ছা হইত তাদের ঘাড়ে ধরিয়া বিদায় করিতে। কিন্তু, ষোড়শীর মুখ চাহিয়া তাহদের পায়ে ধরিতে হইত। এই ছিল তাঁর কঠোর প্রায়শ্চিত্ত। সন্ন্যাসী আসিলেই প্রথমে অন্তঃপরে একবার তার তলব পড়িত। পিসি তাকে লইয়া বসিতেন, ষোড়শী দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া দেখিত। এই সাবধানতার কারণ ছিল এই, পাছে সন্ন্যাসী তাকে প্রথমেই মা বলিয়া ডাকিয়া বসে। কেননা, কী জানি।– বরদার ষে ফোটোগ্রাফখানি ষোড়শীর কাছে ছিল সেটা তার ছেলে-বয়সের । সেই বালকমখের উপর গোঁফদাড়ি জটাজট ছাইভস্ম যোগ করিয়া দিলে সেটার যে কিরকম অভিব্যক্তি হইতে পারে তা বলা শক্ত। কতবার কত মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছে, বাকি কিছ কিছ মেলে ; বকের মধ্যে রক্ত দ্রুত বহিয়াছে, তার পরে দেখা যায়—কন্ঠস্বরে ঠিক মিল নাই, নাকের ডগার কাছটা অন্যরকম। এমনি করিয়া ঘরের কোণে বসিয়াও নতন নতন সন্ন্যাসীর মধ্য দিয়া ষোড়শী যেন বিশ্বজগতে সন্ধানে বাহির হইয়াছে। এই সন্ধানই তার সখে। এই সন্ধানই তার স্বামী, তার জীবনযৌবনের পরিপণতা। এই সন্ধানটিকেই ঘেরিয়া তার সংসারের সমস্ত আয়োজন। সকালে উঠিয়া ইহারই জন্য তার সেবার কাজ আরম্ভ হয়- এর আগে রান্নাঘরের কাজ সে কখনো করে নাই, এখন এই কাজেই তার বিলাস। সমস্তক্ষশই মনের মধ্যে তার প্রত্যাশার প্রদীপ জালানো থাকে। রাত্রে শইতে যাইবার আগে, কাল হয়তো আমার সেই অতিথি আসিয়া পৌছিবে এই চিন্তাটিই তার দিনের শেষ চিন্তা । এই যেমন সন্ধান চলিতেছে, অমনি সেই সঙ্গে যেমন করিয়া বিধাতা তিলোত্তমাকে গড়িয়াছিলেন তেমনি করিয়া ষোড়শী নানা সন্ন্যাসীর শ্রেষ্ঠ উপকরণ মিলাইয়া বরদার মতিটিকে নিজের মনের মধ্যে উজলল করিয়া তুলিতেছিল। পবিত্র তার সত্তা, তেজঃপুঞ্জ তার দেহ, গভীর তার জ্ঞান, অতি কঠোর তার ব্লত। এই সন্ন্যাসীকে অবজ্ঞা করে এমন সাধ্য কার। সকল সন্ন্যাসীর মধ্যে এই এক সন্ন্যাসীরই তো পজা চলিতেছে। স্বয়ং তার বশরও যে এই পাজার প্রধান পজারী, ষোড়শীর কাছে এর চেয়ে গৌরবের কথা আর-কিছু ছিল না। কিন্তু, সন্ন্যাসী প্রতিদিনই তো আসে না। সেই ফাঁকগুলো বড়ো অসহ্য। কমে সে ফকিও ভরিল। ষোড়শী ঘরে থাকিয়াই সন্ন্যাসের সাধনায় লাগিয়া গেল। সে মেকের উপর কবল পাতিয়া শোয়, এক বেলা যা খায় তার মধ্যে ফলমলেই বেশি। গায়ে তার গেরয়া রঙের তসর, কিন্তু সাধব্যের লক্ষণ ফটাইয়া তুলিবার জন্য চওড়া তার লাল পাড়, এবং কল্যাণীর সিথির অধোকটা জড়িয়া মোটা একটা সিন্দরের রেখা। ইহার উপরে বশরকে বলিয়া সংস্কৃত পড়া শরে করিল। মন্থবোধ মাখন্ত করিতে তার অধিক দিন লাগিল না; পণ্ডিতমশায় বলিলেন, একেই বলে পরে জন্মাঙ্গিত বিদ্যা। পবিত্রতায় সে যতই অগ্রসর হইবে সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার অন্তরের মিলন ততই পাপ হইতে থাকিবে, এই সে মনে মনে ঠিক করিয়াছিল। বাহিরের লোকে সকলেই ধন্য-ধন্য করিতে লাগিল; এই সন্ন্যাসী সাধার সাধনী দীর পায়ের ধলা ও আশীবাদ লইবার লোকের ভিড় বাড়িতে থাকিল—এমন-কি, স্বয়ং পিসিও তার কাছে ভরে সম্প্রমে চুপ করিয়া থাকেন। কিন্তু ষোড়শী যে নিজের মন জানিত। তার মনের রঙ তো তার গায়ের তসরের