পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

q○8 গল্পগুচ্ছ আমার তিন-নম্বর প্রতিবেশীকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভুলে থাকতে পারি, কিন্তু আমার এই পয়লা-নম্বরের প্রতিবেশীকে এক মহত আমার ভুলে থাকা শক্ত। রাত্রে তার আট-দশটা ঘোড়া আস্তাবলের কাঠের মেঝের উপর বিনা সংগীতের যে তাল দিতে থাকে তাতে আমার ঘমে সবাঙ্গে টোল খেয়ে তুবড়ে যায়। তার উপর ভোরবেলায় সেই আট-দশটা ঘোড়াকে আট-দশটা সহিস যখন সশব্দে মলতে থাকে তখন সৌজন্য রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তার পরে তাঁর উড়ে বেহারা, ভোজপুরি বেহারা, তাঁর পড়ে তেওয়ারি দরোয়ানের দল কেউই স্বরসংষম কিবা মিতভাষিতার পক্ষপাতী নয়। তাই বলছিলাম, ব্যক্তিটি একটিমাত্র কিন্তু তার গোলমাল করবার যন্ত্র বিস্তর। এইটেই হচ্ছে দৈত্যের লক্ষণ। সেটা তার নিজের পক্ষে অশান্তিকর না হতে পারে। নিজের কুড়িটা নাসারনপ্পে নাক ডাকবার সময় রাবণের হয়তো ঘামের ব্যাঘাত হত না, কিন্তু তার প্রতিবেশীর কথাটা চিন্তা করে দেখো। সবগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে পরিমাণসষমা, অপর পক্ষে একদা যে দানবের বারা সবগের নন্দনশোভা নষ্ট হয়েছিল তাদের প্রধান লক্ষণ ছিল অপরিমিতি। আজ সেই অপরিমিতি দানবটাই টাকার থলিকে বাহন করে মানবের লোকালয়কে আক্রমণ করেছে। তাকে যদি-বা পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যেতে চাই সে চার ঘোড়া হাঁকিয়ে ঘাড়ের উপর এসে পড়ে— এবং উপরন্তু চোখ রাঙায় । সেদিন বিকেলে আমার দ্বৈতগুলি তখনো কেউ আসে নি। আমি বসে বসে জোয়ার-ভাঁটার তত্ত্ব সম্বন্ধে একখানা বই পড়ছিলাম, এমন সময়ে আমাদের বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে দরজা পেরিয়ে আমার প্রতিবেশীর একটা স্মারকলিপি ঝন ঝন শব্দে আমার শাসির উপর এসে পড়ল। সেটা একটি টেনিসের গোলা। চন্দ্রমার আকর্ষণ, পথিবীর নাড়ীর চাঞ্চল্য, বিশ্ববগীতিকাব্যের চিরন্তন ছন্দতত্ত্ব প্রভৃতি সমস্তকে ছাড়িয়ে মনে পড়ল আমার একজন প্রতিবেশী আছেন এবং অত্যন্ত বেশি করে আছেন, আমার পক্ষে তিনি সম্পণ অনাবশ্যক অথচ নিরতিশয় অবশ্যম্ভাবী। পরক্ষণেই দেখি, আমার বড়ো অযোধ্যা বেহারাটা দৌড়তে দৌড়তে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত। এই আমার একমাত্র অনুচর। একে ডেকে পাই নে, হেকে বিচলিত করতে পারি নে— দলভিতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, একা মানুষ কিন্তু কাজ বিস্তর। আজ দেখি, বিনা তাগিদেই গোলা কুড়িয়ে সে পাশের বাড়ির দিকে ছটছে। খবর পেলাম, প্রত্যেকবার গোলা কুড়িয়ে দেবার জন্যে সে চার পয়সা করে মজরি পায় । দেখলাম, কেবল যে আমার শাসি ভাঙছে, আমার শান্তি ভাঙছে, তা নয়, আমার অনচের-পরিচরদের মন ভাঙতে লাগল। আমার অকিঞ্চিৎকরতা সম্বন্ধে অযোধ্যা বেহারার অবজ্ঞা প্রত্যহ বেড়ে উঠছে সেটা তেমন আশ্চৰ্য নয়, কিন্তু আমার দ্বৈতসম্প্রদায়ের প্রধান সদার কানাইলালের মনটাও দেখছি পাশের বাড়ির প্রতি উৎসকে হয়ে উঠল। আমার উপর তার যে নিষ্ঠা ছিল সেটা উপকরণমলেক নয়, অন্তঃকরণমলেক, এই জেনে আমি নিশ্চিত ছিলাম; এমন সময় একদিন লক্ষ করে দেখলাম, সে আমার অযোধ্যাকে অতিক্রম করে টেনিসের পলাতক গোলাটা কুড়িয়ে নিয়ে পাশের বাড়ির দিকে ছটছে। বঝেলম, এই উপলক্ষে প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করতে চায়। সন্দেহ হল, ওর মনের ভাবটা ঠিক ব্রহমবাদিনী মৈত্রেয়ীর মতো নয়—শধ্যে অমতে ওর