পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পয়লা নশ্বর ●●● পেট ভরবে না। আমি পয়লা-নম্বরের বাবগিরিকে খুব তীক্ষ বিদ্রপ করবার চেষ্টা করতুম। বলতুম, সাজসজা দিয়ে মনের শান্যতা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা ঠিক যেন রঙিন মেঘ দিয়ে আকাশ মুড়ি দেবার দরোশা। একটা হাওয়াতেই মেঘ যায় সরে, আকাশের ফাঁকা বেরিয়ে পড়ে। কানাইলাল একদিন প্রতিবাদ করে বললে, মানবেটা একেবারে নিছক ফাঁপা নয়, বি.এ. পাস করেছে। কানাইলাল স্বয়ং বি.এ. পাস-করা, এজন্য ঐ ডিগ্রিটা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারলাম না। পয়লা-নম্ববরের প্রধান গণেগুলি সশব্দ। তিনি তিনটে যন্ত্র বাজাতে পারেন— কনেট, এসরাজ এবং চেলো। যখন-তখন তার পরিচয় পাই। সংগীতের সরে সবন্ধে আমি নিজেকে সরাচার্য বলে অভিমান করি নে। কিন্তু আমার মতে গানটা উচ্চঅঙ্গের বিদ্যা নয়। ভাষার অভাবে মানুষ যখন বোবা ছিল তখনই গানের উৎপত্তি— তখন মানুষ চিন্তা করতে পারত না বলে চীৎকার করত। আজও যে-সব মানুষ আদিম অবস্থায় আছে তারা শধ্যে শধ্যে শব্দ করতে ভালোবাসে। কিন্তু দেখতে পেলাম, আমার দ্বৈতদলের মধ্যে অন্তত চারজন ছেলে আছে, পয়লা-নম্বরের চেলো বেজে উঠলেই যারা গাণিতিক ন্যায়শাস্ত্রের নব্যতম অধ্যায়েও মন দিতে পারে না। আমার দলের মধ্যে অনেক ছেলে যখন পয়লা-নম্ববরের দিকে হেলছে এমন সময়ে অনিলা একদিন আমাকে বললে, “পাশের বাড়িতে একটা উৎপাত জটেছে, এখন আমরা এখান থেকে অন্য-কোনো বাসায় গেলেই তো ভালো হয়।” বড়ো খুশি হলাম। আমার দলের লোকদের বললাম, “দেখেছ মেয়েদের কেমন একটা সহজ বোধ আছে ? তাই যে-সব জিনিস প্রমাণযোগে বোঝা যায় তা ওরা বকেতেই পারে না, কিন্তু যে-সব জিনিসের কোনো প্রমাণ নেই তা বঝেতে ওদের একটাও দেরি হয় না।” কানাইলাল হেসে বললে, “যেমন পেচো, ব্ৰহাদৈত্য, ব্রাহরণের পায়ের ধলোর মাহাত্ম্য, পতিদেবতা-পাজার পণ্যফল ইত্যাদি ইত্যাদি।” আমি বললাম, “না হে, এই দেখো-না, আমরা এই পয়লা-নম্বরের জাঁকজমক দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছি, কিন্তু অনিলা ওর সাজসজায় ভোলে নি।” অনিলা দু-তিনবার বাড়ি-বদলের কথা বললে। আমার ইচ্ছাও ছিল, কিন্তু কলকাতার গলিতে গলিতে বাসা খুজে বেড়াবার মতো অধ্যবসায় আমার ছিল না। অবশেষে একদিন বিকেলবেলায় দেখা গেল, কানাইলাল এবং সতীশ পয়লা-নবরে টেনিস খেলছে। তার পরে জনশ্রুতি শোনা গেল, যতি আর হরেন পয়লা-নম্বরে সংগীতের মজলিসে একজন বক্স-হামোনিয়ম বাজায় এবং একজন বাঁয়া-তবলায় সংগত করে, আর অরণে নাকি সেখানে কমিক গান করে খবে প্রতিপত্তি লাভ করেছে। এদের আমি পাঁচ-ছ বছর ধরে জানি, কিন্তু এদের যে এ-সব গণ ছিল তা আমি সন্দেহও করি নি। বিশেষত আমি জানতুম, অরণের প্রধান শখের বিষয় হচ্ছে তুলনামলক ধমতত্ত্ব। সে যে কমিক গানে ওস্তাদ তা কী করে বঝেব। f সত্য কথা বলি, আমি এই পয়লা-নম্বরকে মুখে যতই অবজ্ঞা করি মনে মনে ঈষা করেছিলাম। আমি চিন্তা করতে পারি, বিচার করতে পারি, সকল জিনিসের সার গ্রহণ করতে পারি, বড়ো বড়ো সমস্যার সমাধান করতে পারি—মানসিক সম্পদে