পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নামঞ্জর গল্প A&& খেতে শীতে তার সময় না-পাওয়াটা বিশেষ সমারোহ করেই ঘটে। এ পাড়ায় ও পাড়ার খবর পৌছয়। কেউ যখন বলে এমন করলে শরীর টিকবে কী করে, সে একটুখানি হাসে—আশ্চর্য সেই হাসি। ভক্তরা বলে, “আপনি একটা বিশ্রাম করন গে, একরকম করে কাজটা সেরে নেব”; সে তাতে ক্ষম হয়—ক্লান্তি থেকে বাঁচানোই কি বড়ো কথা। দুঃখগৌরব থেকে বঞ্চিত করা কি কম বিড়ম্ববনা। তার ত্যাগস্বীকারের ফদের মধ্যে আমিও পড়ে গেছি। আমি যে তার এত বড়ো জেল-খাটা দাদা—উল্লাসকর-কানাইবারীন-উপেন্দ্র প্রভৃতির সঙ্গে এক জ্যোতিকমণ্ডলীতে যার পথান, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পার হয়ে তার যে দাদা গীতার শেষ দিকের অধ্যায়ের মুখে অগ্রসর হয়েছে, তাকেও যথোচিত পরিমাণে দেখবার সে সময় পায় না। এত বড়ো স্যাক্লিফাইস ! যেদিন কোনো কারণে তার দলের লোকের অভাব হয়েছে সেদিন আমিও তার উৎসাহের মেীতাত জোগাবার জন্য বলেছি, “অমিয়া, ব্যক্তিগত মানুষের সঙ্গে সম্প্ৰবন্ধ তোর জন্যে নয়, তোর জন্যে বৰ্তমান যগে।” আমার কথাটা সে গম্ভীরমুখে নীরবে মেনে নিয়েছে। জেলে যাওয়ার পর থেকে আমার হাসি অন্তঃশীলা বইছে— বারা আমাকে চেনে না তারা বাইরে থেকে আমাকে খরব গম্ভীর বলেই মনে করে। বিছানায় একলা পড়ে পড়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি : বিমলখা বান্ধবা যান্তি । হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেদিন কোথা থেকে একটা ন্যাঙলা কুকুর আমার বারান্দার কোণে আশ্রয় খুজছিল। গায়ের রোওয়া উঠে গেছে, জীণ চামড়ার তলায় ককালের আর নেই— আধমরা তার অবস্থা। অত্যন্ত ঘণার সঙ্গে তাকে দর-দর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেম। আজ ভাবছিলেম, এতটা বেশি ঝাঁজের সঙ্গে তাকে তাড়ালেম কেন। বেগানা কুকুর বলে নয়, ওর সবাগে মরণদশা দেখা দিয়েছে বলে। প্রাণের সংগীতসভায় ওর অস্তিত্বটা বেসরো, ওর রগেণতা বেয়াদবি । ওর সঙ্গে নিজের তুলনা মনে এল। চারি দিকের চলমান প্রাণের ধারার মধ্যে আমার অস্বাস্থ্য একটা পথাবর পদার্থ, স্রোতের বাধা। সে দাবি করে, শিয়রের কাছে চুপ করে বসে থাকো। প্রাণের দাবি, দিকে বিদিকে চলে বেড়াও । রোগের বাঁধনে ষে নিজে বন্ধ, আরোগীকে সে বন্দী করতে চায়— এটা একটা অপরাধ। অতএব, জীবলোকের উপর সব দাবি একেবারে পরিত্যাগ করব মনে করে গীতা খালে বসলেম। প্রায় যখন স্থিতধী অবস্থায় এসে পোঁচেছি, মনটা রোগ-আরোগের বন্ধ ছাড়িয়ে গেছে, এমন সময় অনুভব করলেম কে আমার পা ছয়ে প্রণাম করলে। গীতা থেকে চোখ নামিয়ে দেখি, পিসিমার পোষ্যমণ্ডলীভুক্ত একটি মেয়ে। এ পর্যন্ত দরের থেকেই সাধারণভাবেই তাকে জানি ; বিশেষভাবে তার পরিচয় জানি নে— তার নাম পৰ্যন্ত আমার অবিদিত। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে সে আমার পারে হাত বলিয়ে দিতে লাগল। তখন মনে পড়ল, মাঝে মাঝে সে আমার দরজার বাইরের কোণে ছায়ার মতো এসে বারবার ফিরে ফিরে গেছে। বোধ করি সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারে নি। আমার অজ্ঞাতসারে আমার মাথা ধরার, গারে ব্যথার, ইতিবৃত্তান্ত সে আড়াল থেকে অনেকটা জেনে গিয়েছে। আজ সে লজাভয় দরে করে ঘরের মধ্যে এসে প্রণাম করে বসল। আমি যে একদিন একজন মেয়েকে অপমান থেকে বাঁচাবার জন্যে দুঃখস্বীকারের অষ" নারীকে দিয়েছি, সে হয়তো বা দেশের সমস্ত মেয়ের হয়ে আমার পায়ের কাছে তারই প্রাপ্তিস্বীকার করতে এসেছে। জেল থেকে বেরিয়ে অনেক সভায় অনেক মালা পেয়েছি,