পাতা:গোড়ায় গলদ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোড়ায় গলদ ○○ নলিনাক্ষ। তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাই। এখন তুমি সেখানে একলা, মনে করছি কিছুদিন তোমার সঙ্গে একত্র থেকে— . বিনোদবিহারী। না না, আমি শীঘ্রই আমার স্ত্রীকে ঘরে আনছি— নলিন, আজ ভাই তুমি চন্দরকে নিয়ে গোলদিঘিঙে বেড়াতে যাও— আমাকে একটু ছুটি দিতেই হচ্ছে। নলিনাক্ষ। (সনিশ্বাসে ) তবে বিদায় ভাই ! কিন্তু এই শেষ কথা বলে যাচ্ছি, র্যাদের তুমি তোমার প্রাণের বন্ধু বলে জান, তারা তোমাকে হয়তো এক কথায় ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু নলিনাক্ষ তোমাকে কখনোই ছাড়বে না। বিনোদবিহারী। সে আমি খুবই জানি নলিন। নলিনাক্ষ । আর এটা নিশ্চয় মনে রেখো, তুমি যা কর আমি তোমার পক্ষে আছি। তৃতীয় দৃশ্য নিবারণের অন্তঃপুর ইন্দুমতী ও কমলমুখী কমলমুখী। না ভাই ইন্দু, ওরকম করে তুই বলিস নে। তুই যতটা বাড়িয়ে দেখছিস আসলে ততটা কিছু নয়— ইন্দুমতী। না, তা কিছু নয়! তিনি অতি উত্তম কাজ করেছেন— বাঙালির ঘরে এতবড়ো মহাপুরুষ আর জন্মগ্রহণ করেন নি— ওঁর মহত্ত্বের কথা সোনার জলে ছাপিয়ে কপালে মেরে ওঁকে একবার ঘরে ঘরে দেখিয়ে আনলে হয় ! দিদি, এই কদিনে তোর বুদ্ধি খারাপ হয়ে গেছে। তুই কি বলতে চাস আমাদের বিনোদবাবু ভারি উদার স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন। কমলমুখী। তুই ভাই, সব কথা বড়ো বেশি বাড়িয়ে বলিস, ওটা তোর একটা দোষ ইন্দু। একবার ভালো করে ভেবে দেখ দেখি, হঠাৎ একজন লোককে বলা গেল আজ থেকে তুমি অমুক লোকটাকে ভালোবাসবে, সে যদি অমনি তক্‌খনি ঘোড়ায় চড়ে আদেশ পালন করতে না পারে তা হলে তাকে কি দোষ দেওয়া যায়। বিয়ের মন্তর সত্যি যদি ভালোবাসার মন্তর হত তা হলে খেমাপিসির এমন দুর্দশা কেন, তা হলে বিরাজদিদি এতকাল কেঁদে মরছেন কেন। ইন্দুমতী। ভাই, তোকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। বিয়ের মন্তর যে ভালোবাসার মন্তর নয় তা কে বলবে। আচ্ছা দিদি, এক রাত্তিরে তোর এত ভালোবাসা জন্মাল কোথা থেকে— বিয়ে হলে কী রকম মনে হয় আমাকে সত্যি করে বল দেখি। কমলমুখী। কী জানি, বিয়ের পরেই মনে হয়, বিধাতা সমস্ত জগৎ থেকে একটি মানুষকে স্বতন্ত্র করে নিয়ে তার সমস্ত সুখদুঃখের ভার আমার উপর দিলেন— আমি তাকে দেখব, সেবা করব, যত্ন করব, তার সংসারের ভার লাঘব করব, আর-সকলের কাছ থেকে তার সমস্ত দোষ দুর্বলতা আবরণ করে রেখে দেব। এইমাত্র যে তাকে বিয়ে করলুম তা মনে হয় না ; মনে হয় আজন্মকাল এবং জন্মাবার পূর্বে থেকে এই একমাত্র মানুষের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয়েছিল— ইন্দুমতী। তোর যদি এতটা হল, তো বিনোদবাবুর হয় না কেন। কমলমুখী। তুই বুঝিস নে ইন্দু, ওরা যে পুরুষমানুষ। আমাদের এক ভাব ওদের আর-এক ভাব। জানিস নে, মার কোলে ছেলেটি হবামাত্রই সে কালোই হোক আর সুন্দরই হোক তাকে সেই মুহূর্ত থেকে ভালোবাসতে না পারলে এ সংসার চলে না— তেমনি স্ত্রীর অদৃষ্টে যে-স্বামীই জোটে তক্‌খনি যদি সে তাকে ভালোবাসতে না পারে তা হলে সে স্ত্রীরই বা কী দশা হয় আর এই পৃথিবীই বা টেকে