পাতা:গোড়ায় গলদ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○Vり গোড়ায় গলদ কী করে। মেয়েমানুষের ভালোবাসা সবুর করতে পারে না, বিধাতা তার হাতে সে অবসর দেন নি। পুরুষমানুষ রয়ে বসে অনেক ঠেকে অনেক ঘা খেয়ে তার পরে ভালোবাসতে শেখে, ততদিন পৃথিবী সবুর করে থাকে, কাজের ব্যাঘাত হয় না। ইন্দুমতী। ইস! কী সব নবাব ! আচ্ছা দিদি, তুই কি বলিস নিমে গয়লার সঙ্গে আজই যদি আমার বিয়ে হয় আমনি কাল ভোর থেকেই তাড়াতাড়ি তার চরণদুটো ধরে সেবা করতে বসে যাব— মনে করব, ইনি আমার চিরকালের গয়লা, আমার পূর্বজন্মের গয়লা, বিধাতা একে এবং এর অন্য গোরুগুলিকে গোয়ালসুদ্ধ আমারই হাতে সমর্পণ করে দিয়েছেন । কমলমুখী। ইন্দু, তুই কী যে বকিস আমি তোর সঙ্গে পেরে উঠি নে। নিমে গয়লাকে তুই বিয়ে করতে যাবি কেন— সে একে গয়লা তাতে আবার তার দুই বিয়ে । ইন্দুমতী। আচ্ছা, নাহয় নিমে গয়লা নাই হল— পৃথিবীতে নিমাইচন্দ্রের তো অভাব নেই। কমলমুখী। তা, তোর অদৃষ্টে যদি কোনো নিমাই থাকে তা হলে অবশ্যি তাকে ভালোবাসবি।— ইন্দুমতী। ককখনো বাসব না। আচ্ছা, তুমি দেখো। বিয়ে করেছি বলেই যে অমনি তার পরদিন থেকে নিমাই-নিমাই করে খেপে বেড়াব আমাকে তেমন মেয়ে পাও নি। আমি দিদি, তোর মতন না ভাই ! তোরা ঐ রকম করিস বলেই তো পুরুষগুলোর দেমাক বেড়ে যায়। নইলে তাদের আছে কী ? যেমন মূর্তি তেমনি স্বভাব ! সাধে তাদের পায়া ভারী হয়— তোদের যে সেই পায়ে তেল দিতে একদণ্ড তর সয় না। তুই হাসছিস দিদি, কিন্তু আমি সত্যি বলছি, ঐ দাড়িমুখগুলো না হলে কি আর আমাদের একেবারে চলে না। কেন ভাই, তোতে আমাতে তো বেশ ছিলুম। আমাদের কিসের অভাব ছিল। মাঝখানে একজন অপরিচিত পুরুষ এসে আমাদের অপমান করে যায় কেন। যেন আমরা ওঁদের বাড়ির বাগানের বেগুন, ইচ্ছে করলেই তুলে নিতে পারেন, ইচ্ছে করলেই ফেলে দিতে পারেন। আচ্ছা, মনে কর-না, আমিই তোর স্বামী। আমি তোকে যত যত্ন করব, যত ভালোবাসব, তোর সাতগণ্ডা গোফদাড়ি তেমন পারবে না। কমলমুখী। আসলে জানিস ইন্দু, ওদের না হলে আমাদের চলতে পারে কিন্তু আমাদের না হলে পুরুষমানুষের চলে না, সেইজন্যে ওদের আমরা ভালোবাসি। ওরা নিজের যত্ব নিজে করতে জানে না— ওদের সর্বদা সামলে রাখবার এবং দেখবার লোক একজন চাই। মনে হয়, যেন আমাদের চেয়ে ওদের ঢের বেশি জিনিসের দরকার, ওদের মস্ত শরীর, মস্ত খিদে, মস্ত আবদার। আমাদের সব তাতেই চলে যায়, ওদের একটু-কিছু হলেই একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে। আমাদের মতো ওদের এমন মনের জোর নেই—ওরা এত সহ্য করতে পারে না। সেইজন্যেই তো ওদের এতটা বেশি ভালোবাসতে হয়, নইলে ওদের কী দশা হত । নিবারণের প্রবেশ নিবারণ। মা, তোমাকে দেখলে আমি চোখের জল রাখতে পারি নে। আমার মার কাছে আমি অপরাধী— তোমার কাছে আমার দাড়ানো উচিত হয় না। কমলমুখী। কাকা, আপনি অমন করে বলবেন না ; আমার অদৃষ্টে যা ছিল তাই হয়েছে— ইন্দুমতী। বাবা, আসলে যার অপরাধ তাকে কিছু না বলে তার অপরাধ তোমরা পাচজনে কেন ভাগ করে নিচ্ছ আমি তো বুঝতে পারি নে। নিবারণ। থাক মা, সে-সব আলোচনা থাক— এখন একটা কাজের কথা বলি, কমল, মন দিয়ে শোনো। তোমাকে এতদিন গরিবের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে এসেছি, সে-কথাটা ঠিক নয়। তোমার বাপের বিষয়সম্পত্তি নিতান্ত সামান্য ছিল না— আমারই হাতে সে-সমস্ত আছে— ইতিমধ্যে অনেক টাকা জমেছে এবং সুদেও বেড়েছে। তোমার বাপ বলে গিয়েছিলেন তোমার কুড়ি বৎসর বয়স হলে তবে এই-সমস্ত বিষয়সম্পত্তি তোমার হাতে দেওয়া হয়। তার আশঙ্কা ছিল পাছে তোমার বিষয়ের লোভে কেউ তোমাকে বিবাহ করে, তার পরে মদ খেয়ে অসৎ ব্যয় করে উড়িয়ে দেয়। তোমার বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে বিষয় পেলে তুমি তার ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারবে। যদিও তোমার সে বয়স হয়