পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

“দিদি, খাবার তৈরি হয়েছে। মা ছাতে আসতে বললেন।”

 ছাতে আসিয়া বিনয়কে আহারে প্রবৃত্ত হইতে হইল। বরদাসুন্দরী তাঁহার সব সন্তানদের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিতে লাগিলেন। ললিতা সুচরিতাকে ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। লাবণ্য একটা চৌকিতে বসিয়া ঘাড় হেঁট করিয়া দুই লোহার কাঠি লইয়া বুনানির কার্যে লাগিল। তাহাকে কবে একজন বলিয়াছিল, বুনানির সময় তাহার কোমল আঙুলগুলির খেলা ভারি সুন্দর দেখায়; সেই অবধি লোকের সাক্ষাতে বিনা প্রয়োজনে বুনানি করা তাহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল।

 পরেশ আসিলেন। সন্ধ্যা হইয়া আসিল। আজ রবিবারে উপাসনা- মন্দিরে যাইবার কথা। বরদাসুন্দরী বিনয়কে কহিলেন, “যদি আপত্তি না থাকে, আমাদের সঙ্গে সমাজে যাবেন?”

 ইহার পর কোনো ওজর-আপত্তি করা চলে না। দুই গাড়িতে ভাগ করিয়া সকলে উপাসনালয়ে গেলেন। ফিরিবার সময় যখন গাড়িতে উঠিতেছেন তখন হঠাৎ সুচরিতা চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “ওই-যে গৌরমোহনবাবু যাচ্ছেন।”

 গোরা যে এই দলকে দেখিতে পাইয়াছিল তাহাতে কাহারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু যেন দেখিতে পায় নাই, এইরূপ ভাব করিয়া সে বেগে চলিয়া গেল। গোরার এই উদ্ধত অশিষ্টতায় বিনয় পরেশবাবুদের কাছে লজ্জিত হইয়া মাথা হেঁট করিল। কিন্তু সে মনে মনে স্পষ্ট বুঝিল, বিনয়কেই এই দলের মধ্যে দেখিয়া গোর এমন প্রবল বেগে বিমুখ হইয়া চলিয়া গেল। এত ক্ষণ তাহার মনের মধ্যে যে-একটি আনন্দের আলো জ্বলিতেছিল তাহা একেবারে নিবিয়া গেল। সুচরিতা বিনয়ের মনের ভাব ও তাহার কারণটা তখনই বুঝিতে পারিল, এবং বিনয়ের মতো বন্ধুর প্রতি গোরার এই অবিচারে ও ব্রাহ্মদের প্রতি তাহার এই অন্যায় অশ্রদ্ধায় গোরার উপরে আবার তাহার রাগ হইল— কোনো মতে গোরার পরাভব ঘটে, এই সে মনে মনে ইচ্ছা করিল।

৯৮