পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গলিতে জাগরণের লক্ষণ নাই, কেবল প্রতিবেশীর আস্তাবলে কাঠের মেজের উপর ঘোড়ার খুরের শব্দ এক-একবার শোনা যাইতেছে এবং কুকুর ঘেউঘেউ করিয়া উঠিতেছে। দুইজনে অনেক ক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে বিনয়, প্রথমটা একটু দ্বিধা করিয়া, অবশেষে পরিপূর্ণবেগে তাহার মনের কথাকে বন্ধনমুক্ত করিয়া দিল। বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি জানি, এ-সব বিষয়ে তোমার মন নেই, কিন্তু তোমাকে না বললে আমি বাঁচব না। আমি ভালোমনদ কিছুই বুঝতে পারছি নে- কিন্তু এটা নিশ্চয়, এর সঙ্গে কোনো চাতুরী খাটবে না। বইয়েতে অনেক কথা পড়েছি এবং এতদিন মনে করে এসেছি সব জানি। ঠিক যেন ছবিতে জল দেখে মনে করতুম সাঁতার দেওয়া খুব সহজ- কিন্তু আজ জলের মধ্যে পড়ে এক মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি এ তো ফাঁকি নয়।”

 এই বলিয়া বিনয় তাহার জীবনের এই আশ্চর্য আবির্ভাবকে একান্ত চেষ্টায় গোরার সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত করিতে লাগিল।

 বিনয় বলিতে লাগিল, আজকাল তাহার কাছে সমস্ত দিন ও রাত্রির মধ্যে কোথাও যেন কিছু ফাঁক নাই— সমস্ত আকাশের মধ্যে কোথাও যেন কোনো রন্ধ্র নাই, সমস্ত একেবারে নিবিড়ভাবে ভরিয়া গেছে বসন্তকালের মউচাক যেমন মধুতে ভরিয়া ফাটিয়া যাইতে চায়, তেমনিতরো। আগে এই বিশ্বচরাচরের অনেকখানি তাহার জীবনের বাহিরে পড়িয়া থাকিত- যেটুকুতে তাহার প্রয়োজন সেইটুকুতেই তাহার দৃষ্টি বদ্ধ ছিল। আজ সমস্তই তাহার সম্মুখে আসিতেছে, সমস্তই তাহাকে স্পর্শ করিতেছে, সমস্তই একটা নূতন অর্থে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সে জানিত না পৃথিবীকে সে এত ভালোবাসে, আকাশ এমন আশ্চর্য, আলোক এমন অপূর্ব, রাস্তার অপরিচিত পথিকের প্রবাহও এমন গভীরভাবে সত্য। তাহার ইচ্ছা করে সকলের জন্য সে একটা-কিছু করে, তাহার সমস্ত শক্তিকে আকাশের সূর্যের মতো সে জগতের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।

 বিনয় যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গে এই-সমস্ত কথা বলিতেছে তাহা

১০৭