পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 প্রধান পক্ষের নিকট হইতে কোনো প্রস্তাব উপস্থিত না হইলেও হারানবাবুর সঙ্গেই সুচরিতার বিবাহ নিশ্চয় বলিয়া সকলে যখন স্থির করিয়াছিল তখন সুচরিতাও মনে মনে তাহাতে সায় দিয়াছিল এবং হারানবাবু ব্রাহ্মসমাজের যে-সকল হিতসাধনের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন কিরূপ শিক্ষা ও সাধনার দ্বারা সেও তাহার উপযুক্ত হইবে এই তাহার এক বিশেষ উৎকণ্ঠার বিষয় হইয়া উঠিয়াছিল। সে যে কোনো মানুষকে বিবাহ করিতে যাইতেছে তাহা হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিতে পারে নাই— সে যেন ব্রাহ্মসম্প্রদায়ের সুমহৎ মঙ্গলকে বিবাহ করিতে প্রস্তুত হইয়াছে, সেই মঙ্গল প্রচুর-গ্রন্থপাঠ দ্বারা অত্যুচ্চ বিদ্বান এবং তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা নিরতিশয় গম্ভীর। এই বিবাহের কল্পনা তাহার কাছে ভয় সম্ভ্রম ও দুঃসাধ্য দায়িত্ববোধের দ্বারা রচিত একটা পাথরের কেল্লার মতো বোধ হইতে লাগিল— তাহা যে কেবল সুখে বাস করিবার তাহা নহে, তাহা লড়াই করিবার— তাহা পারিবারিক নহে, তাহা ঐতিহাসিক।

 এই অবস্থাতেই যদি বিবাহ হইয়া যাইত তবে অন্তত কন্যাপক্ষের সকলেই এই বিবাহকে বিশেষ একটা সৌভাগ্য বলিয়াই জ্ঞান করিত। কিন্তু হারানবাবু নিজের উৎকৃষ্ট মহৎ জীবনের দায়িত্বকে এতই বড়ো করিয়া দেখিতেন যে কেবলমাত্র ভালো লাগার দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া বিবাহ করাকে তিনি নিজের অযোগ্য বলিয়া জ্ঞান করিলেন। এই বিবাহ-দ্বারা ব্রাহ্মসমাজ কী পরিমাণে লাভবান হইবে তাহা সম্পূর্ণ বিচার না করিয়া তিনি এ কাজে প্রবৃত্ত হইতে পারিলেন না। এই কারণে তিনি সেই দিক হইতে সুচরিতাকে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন।

 এরূপ ভাবে পরীক্ষা করিতে গেলে পরীক্ষা দিতেও হয়। হারানবাবু পরেশবাবুর ঘরে সুপরিচিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহাকে তাঁহার বাড়ির লোকে যে পানুবাবু বলিয়া ডাকিত, এ পরিবারেও তাঁহার সেই পানুবাবু নাম প্রচার হইল। এখন তাঁহাকে কেবলমাত্র ইংরেজি বিদ্যার ভাণ্ডার, তত্ত্বজ্ঞানের আধার ও ব্রাহ্মসমাজের মঙ্গলের অবতাররূপে দেখা সম্ভবপর হইল না— তিনি যে মানুষ, এই পরিচয়টাই সকলের চেয়ে নিকট হইয়া উঠিল। তখন

১১৭