পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

জিনিসগুলা রাস্তায় গড়াগড়ি গেল এবং ক্রুদ্ধ বাবু কোচবাক্স হইতে ফিরিয়া তাহাকে “ড্যাম শুয়ার' বলিয়া গালি দিয়া তাহার মুখের উপর সপাং করিয়া চাবুক বসাইয়া দিতে তাহার কপালে রক্তের রেখা দেখা দিল। বৃদ্ধ “আল্লা' বলিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া যে জিনিসগুলা নষ্ট হয় নাই তাহাই বাছিয়া ঝাঁকায় তুলিতে প্রবৃত্ত হইল। গোরা ফিরিয়া আসিয়া বিকীর্ণ জিনিসগুলা নিজে কুড়াইয়া তাহার ঝাঁকায় উঠাইতে লাগিল। মুসলমান মুটে ভদ্রলোক পথিকের এই ব্যবহারে অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া কহিল, “আপনি কেন কষ্ট করছেন বাবু, এ আর কোনো কাজে লাগবে না।”

 গোরা এ কাজের অনাবশ্যকতা জানিত এবং সে ইহাও জানিত যাহার সাহায্য করা হইতেছে, সে লজ্জা অনুভব করিতেছে— বস্তুত সাহায্য হিসাবে এরূপ কাজের বিশেষ মূল্য নাই— কিন্তু এক ভদ্রলোক যাহাকে অন্যায় অপমান করিয়াছে আর-এক ভদ্রলোক সেই অপমানিতের সঙ্গে নিজেকে সমান করিয়া ধর্মের ক্ষুব্ধ ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য আনিতে চেষ্টা করিতেছে এ কথা রাস্তার লোকের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। ঝাঁকা ভর্তি হইলে গোরা তাহাকে বলিল, “যা লোকসান গেছে সে তো তোমার সইবে না। চলো, আমাদের বাড়ি চলো, আমি সমস্ত পুরো দাম দিয়ে কিনে নেব। কিন্তু বাবা, একটা কথা তোমাকে বলি, তুমি কথাটি না বলে যে অপমান সহ্য করলে আল্লা তোমাকে এজন্য মাপ করবেন না।”

 মুসলমান কহিল, “যে দোষী আল্লা তাকেই শাস্তি দেবেন, আমাকে কেন দেবেন?”

 গোরা কহিল, “যে অন্যায় সহ্য করে সেও দোষী, কেননা সে জগতে অন্যায়ের সৃষ্টি করে। আমার কথা বুঝবে না, তবু মনে রেখো, ভালোমানুষি ধর্ম নয়; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মহম্মদ সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্মপ্রচার করেন নি।”

 সেখান হইতে গোরাদের বাড়ি নিকট নয় বলিয়া গোরা সেই মুসলমানকে বিনয়ের বাসায় লইয়া গেল। বিনয়ের দেরাজের সামনে দাঁড়াইয়া বিনয়কে

১৩০