পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

মূর্তি দেখা যেত যার জন্য প্রাণ দেওয়া সহজ হত— অন্তত, তা হলে দেশের মেয়েরা যেন কোথাও নেই এরকম ভুল আমাদের কখনোই ঘটতে পারত না। জানি ইংরেজের সমাজের সঙ্গে কোনোরকম তুলনা করতে গেলেই তুমি আগুন হয়ে উঠবে— আমি তা করতে চাই নে— আমি জানি নে ঠিক কতটা পরিমাণে এবং কি রকম ভাবে আমাদের মেয়েরা সমাজে প্রকাশ পেলে তাদের মর্যাদা লঙ্ঘন হয় না, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, মেয়েরা প্রচ্ছন্ন থাকাতে আমাদের স্বদেশ আমাদের কাছে অর্ধসত্য হয়ে আছে— আমাদের হৃদয়ে পূর্ণপ্রেম এবং পূর্ণশক্তি দিতে পারছে না।

 গোরা। তুমি এ কথাটা সম্প্রতি হঠাৎ আবিষ্কার করলে কী করে?

 বিনয়। হাঁ, সম্প্রতিই আবিষ্কার করেছি এবং হঠাৎ আবিষ্কারই করেছি। এতবড়ো সত্য আমি এতদিন জানতুম না। জানতে পেরেছি বলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলেই মনে করছি। আমরা যেমন চাষাকে কেবলমাত্র তার চাষবাস, তাঁতিকে তার কাপড় তৈরির মধ্যে দেখি বলে তাদের ছোটোলোক বলে অবজ্ঞা করি, তারা সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের চোখে পড়ে না, এবং ছোটোলোক-ভদ্রলোকের সেই বিচ্ছেদের দ্বারাই দেশ দুর্বল হয়েছে, ঠিক সেইরকম কারণেই দেশের মেয়েদের কেবল তাদের রান্নাবান্না বাটনা-বাটার মধ্যে আবদ্ধ করে দেখছি বলেই মেয়েদের মেয়েমানুষ বলে অত্যন্ত খাটো করে দেখি— এতে করে আমাদের সমস্ত দেশই খাটো হয়ে গেছে।

 গোরা। দিন আর রাত্রি, সময়ের এই যেমন দুটো ভাগ— পুরুষ এবং মেয়েও তেমনি সমাজের দুই অংশ। সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় স্ত্রীলোক রাত্রির মতোই প্রচ্ছন্ন— তার সমস্ত কাজ নিগূঢ় এবং নিভৃত। আমাদের কর্মের হিসাব থেকে আমরা রাতকে বাদ দিই। কিন্তু বাদ দিই বলে তার যে গভীর কর্ম তার কিছুই বাদ পড়ে না। সে গোপন বিশ্রামের অন্তরালে আমাদের ক্ষতিপূরণ করে, আমাদের পোষণের সহায়তা করে। যেখানে সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থা সেখানে রাতকে জোর করে দিন করে তোলে— সেখানে গ্যাস জ্বালিয়ে কল চালানো হয়, বাতি জ্বালিয়ে সমস্ত

১৩৫