পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গানটা লিখিয় লয়। কিন্তু ভোর-রাত্রে যেমন শীত শীত করে অথচ গায়ের কাপড়টা টানিয়া লইতে উদ্যম থাকে না, তেমনি একটা আলস্যের ভাবে বাউলকে ডাকা হইল না, গান লেখাও হইল না, কেবল ওই অচেনা পাখির স্বরটা মনের মধ্যে গুন্‌ গুন্‌ করিতে লাগিল।

 এমন সময় ঠিক তাহার বাসার সামনেই একটা ঠিকাগাড়ির উপরে একটা মস্ত জুড়িগাড়ি আসিয়া পড়িল এবং ঠিকাগাড়ির একটা চাকা ভাঙিয়া দিয়া দৃকপাত না করিয়া বেগে চলিয়া গেল। ঠিকাগাড়িটা সম্পূর্ণ উলটাইয়া না পড়িয়া এক পাশে কাত হইয়া পড়িল।

 বিনয় তাড়াতাড়ি রাস্তায় বাহির হইয়া দেখিল, গাড়ি হইতে একটি সতেরো-আঠারো বৎসরের মেয়ে নামিয়া পড়িয়াছে, এবং ভিতর হইতে একজন বৃদ্ধগোছের ভদ্রলোক নামিবার উপক্রম করিতেছেন।

 বিনয় তাহাকে ধরাধরি করিয়া নামাইয়া দিল, এবং তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেছে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার লাগে নি তো?”

 তিনি “না, কিছু হয় নি” বলিয়া হাসিবার চেষ্টা করিলেন; সে হাসি তখনই মিলাইয়া গেল এবং তিনি মূৰ্ছিত হইয়া পড়িবার উপক্রম করিলেন। বিনয় তাহাকে ধরিয়া ফেলিল ও উৎকণ্ঠিত মেয়েটিকে কহিল, “এই সামনেই আমার বাড়ি; ভিতরে চলুন।”  বৃদ্ধকে বিছানায় শোয়ানো হইলে মেয়েটি চারি দিকে তাকাইয়া দেখিল, ঘরের কোণে একটি জলের কুঁজা আছে। তখনি সেই কুঁজার জল গেলাসে করিয়া লইয়া বৃদ্ধের মুখে ছিটা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল এবং বিনয়কে কহিল, “একজন ডাক্তার ডাকলে হয় না?”

 বাড়ির কাছেই ডাক্তার ছিল। বিনয় তাহাকে ডাকিয়া আনিতে বেহার পাঠাইয়া দিল।

 ঘরের এক পাশে টেবিলের উপরে একটা আয়না, তেলের শিশি ও চুল আঁচড়াইবার সরঞ্জাম ছিল। বিনয় সেই মেয়েটির পিছনে দাঁড়াইয়া সেই আয়নার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।