পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেশে সাম্য না থাকে তবে দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সে তত্ত্ব থাকলেই কী আর না থাকলেই কী?”

 সুচরিতা পরেশবাবুর কথা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া মনে মনে বুঝিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। অবশেষে কহিল, “আচ্ছা বাবা, তুমি বিনয়বাবুদের এ-সব কথা বোঝাবার চেষ্টা কর না কেন?”

 পরেশবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, “বিনয়বাবুদের বুদ্ধি কম বলে যে এ-সব কথা বোঝেন না তা নয়, বরঞ্চ তাঁদের বুদ্ধি বেশি বলেই তাঁরা বুঝতে চান না, কেবল বোঝাতেই চান। তাঁরা যখন ধর্মের দিক থেকে অর্থাৎ সকলের চেয়ে বড়ো সত্যের দিক থেকে এ-সব কথা অন্তরের সঙ্গে বুঝতে চাইবেন তখন তোমার বাবার বুদ্ধির জন্যে তাঁদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে না। এখন তাঁরা অন্য দিক থেকে দেখছেন, এখন আমার কথা তাঁদের কোনো কাজেই লাগবে না।”

 গোরাদের কথা যদিও সুচরিতা শ্রদ্ধার সহিত শুনিতেছিল, তবু তাহা তাহার সংস্কারের সহিত বিবাদ বাধাইয়া তাহার অন্তরের মধ্যে বেদনা দিতেছিল। সে শান্তি পাইতেছিল না। আজ পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিয়া সেই বিরোধ হইতে সে ক্ষণকালের জন্য মুক্তিলাভ করিল। গোরা বিনয় বা আর কেহই যে পরেশবাবুর চেয়ে কোনো বিষয়ে ভালো বুঝে, এ কথা সুচরিতা কোনোমতেই মনে স্থান দিতে চায় না। পরেশবাবুর সঙ্গে যাহার মতের অনৈক্য হইয়াছে সুচরিতা তাহার উপর রাগ না করিয়া থাকিতে পারে নাই। সম্প্রতি গোরার সঙ্গে আলাপের পর গোরার কথা একেবারে রাগ বা অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দিতে পারিতেছিল না বলিয়াই সুচরিতা এমন একটা কষ্ট বোধ করিতেছিল। সেই কারণেই আবার শিশুকালের মতো করিয়া পরেশবাবুকে তাঁহার ছায়াটির ন্যায় নিয়ত আশ্রয় করিবার জন্য তাহার হৃদয়ের মধ্যে ব্যাকুলতা উপস্থিত হইয়াছিল। চৌকি হইতে উঠিয়া দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া সুচরিতা পরেশবাবুর পিছনে তাঁহার চৌকির পিঠের উপর হাত রাখিয়া কহিল, “বাবা, আজ বিকালে আমাকে

১৯৯