পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিতেছিল— আজ রাত্রে গোরা জেলখানায়! আজ পর্যন্ত বিনয় গোরার সকল সুখ-দুঃখেই ভাগ লইয়া আসিয়াছে, এইবার প্রথম তাহার অন্যথা ঘটিল। বিনয় জানিত গোরার মতো মানুষের পক্ষে জেলের শাসন কিছুই নহে, কিন্তু প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে গোরার কোনো যোগ ছিল না— গোরার জীবনের এই একটা প্রধান ঘটনা একেবারেই বিনয়ের সংস্রব ছাড়া। দুই বন্ধুর জীবনের ধারা এই-যে এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে— আবার যখন মিলিবে তখন কি এই বিচ্ছেদের শূন্যতা পূরণ হইতে পারিবে? বন্ধুত্বের সম্পূর্ণতা কি এবার ভঙ্গ হয় নাই? জীবনের এমন অখণ্ড, এমন দুর্লভ বন্ধুত্ব! আজ একই রাত্রে বিনয় তাহার এক দিকের শূন্যতা এবং আর-এক দিকের পূর্ণতাকে একসঙ্গে অভনুব করিয়া জীবনের সৃজনপ্রলয়ের সন্ধিকালে স্তব্ধ হইয়া অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া রহিল।

 গোরা যে ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল দৈবক্রমেই বিনয় তাহাতে যোগ দিতে পারে নাই, অথবা গোরা যে জেলে গিয়াছে দৈবক্রমেই সেই কারাদুঃখের ভাগ লওয়া বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব হইয়াছে, এ কথা যদি সত্য হইত তবে ইহাতে বন্ধুত্ব ক্ষুণ্ন হইতে পারিত না। কিন্তু গোরা ভ্রমণে বাহির হইয়াছিল এবং বিনয় অভিনয় করিতেছিল ইহা আকস্মিক ব্যাপার নহে। বিনয়ের সমস্ত জীবনের ধারা এমন একটা পথে আসিয়া পড়িয়াছে যাহা তাহাদের পূর্ব-বন্ধুত্বের পথ নহে, সেই কারণেই এতদিন পরে এই বাহ্য বিচ্ছেদও সম্ভবপর হইয়াছে। কিন্তু আজ আর কোনো উপায় নাই— সত্যকে অস্বীকার করা আর চলে না, গোরার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন এক পথ অনন্যমনে আশ্রয় করা বিনয়ের পক্ষে আজ আর সত্য নহে। কিন্তু গোরা ও বিনয়ের চিরজীবনের ভালোবাসা কি এই পথভেদের দ্বারাই ভিন্ন হইবে? এই সংশয় বিনয়ের হৃদয়ে হৃৎকম্প উপস্থিত করিল। সে জানিত গোরা তাহার সমস্ত বন্ধুত্ব এবং সমস্ত কর্তব্যকে এক লক্ষ্যপথে না টানিয়া চলিতে পারে না। প্রচণ্ড গোরা! তাহার প্রবল ইচ্ছা! জীবনের সকল সম্বন্ধের

২৪৬