পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চোখের জলে ভাসিতে থাকেন; সুচরিতারও দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িত। সে তাঁহার গলা জড়াইয়া বলিত, “মাসি, আমিও তো মায়ের আদর বেশি দিন ভোগ করতে পারি নি; আজ আবার সেই হারানো মা ফিরে এসেছেন। কত দিন কত দুঃখের সময় যখন ঈশ্বরকে ডাকবার শক্তি ছিল না, যখন মনের ভিতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল, তখন আমার মাকে ডেকেছি। সেই মা আজ আমার ডাক শুনে এসেছেন।”

 হরিমোহিনী বলিতেন, “অমন করে বলিস নে, বলিস নে। তোর কথা শুনলে আমার এত আনন্দ হয় যে আমার ভয় করতে থাকে। হে ঠাকুর, দৃষ্টি দিয়ো না ঠাকুর! আর মায়া করব না মনে করি— মনটাকে পাষাণ করেই থাকতে চাই কিন্তু পারি নে যে। আমি বড়ো দুর্বল, আমাকে দয়া করো, আমাকে আর মেরো না! ওরে রাধারানী, যা, যা, আমার কাছ থেকে ছেড়ে যা। আমাকে আর জড়াস নে রে, জড়াস নে! ও আমার গোপীবল্লভ, আমার জীবননাথ, আমার গোপাল, আমার নীলমণি, আমাকে এ আবার কী বিপদে ফেলছ!"

 সুচরিতা কহিত, “আমাকে তুমি জোর করে বিদায় করতে পারবে না মাসি! আমি তোমাকে কখনো ছাড়ব না— আমি বরাবর তোমার এই কাছেই রইলুম।”

 বলিয়া তাঁহার বুকের মধ্যে মাথা রাখিয়া শিশুর মতো চুপ করিয়া থাকিত।

 দুই দিনের মধ্যেই সুচরিতার সঙ্গে তাহার মাসির এমন একটা গভীর সম্বন্ধ বাধিয়া গেল যে ক্ষুদ্র কালের দ্বারা তাহার পরিমাপ হইতে পারে না।

 বরদাসুন্দরী ইহাতেও বিরক্ত হইয়া গেলেন। “মেয়েটার রকম দেখো। যেন আমরা কোনোদিন উহার কোনো আদর-যত্ন করি নাই। বলি, এতদিন মাসি ছিলেন কোথায়! ছোটোবেলা হইতে আমরা যে এত করিয়া মানুষ করিলাম আর আজ মাসি বলিতেই একেবারে অজ্ঞান। আমি কর্তাকে বরাবর বলিয়া আসিয়াছি, ঐ-যে সুচরিতাকে তোমরা সবাই ভালো ভালো কর, ও কেবল বাহিরে ভালোমানুষি করে, কিন্তু উহার মন পাবার

৩০০