পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লইবার সময়ও তিনি যে তাহার প্রতি চিত্তকে প্রতিকূল করিয়া রহিলেন, এই বেদনাই সুচরিতাকে সব চেয়ে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল।

 লাবণ্য ললিতা লীলা সুচরিতার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিতে লাগিল। তাহারা অত্যন্ত উৎসাহ করিয়া তাহার নূতন বাড়ির ঘর সাজাইতে গেল, কিন্তু সেই উৎসাহের ভিতরেও অব্যক্ত বেদনার অশ্রুজল প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল।

 এতদিন পর্যন্ত সুচরিতা নানা ছুতা করিয়া পরেশবাবুর কত-কী ছোটোখাটো কাজ করিয়া আসিয়াছে। হয়তো ফুলদানিতে ফুল সাজাইয়াছে, টেবিলের উপর বই গুছাইয়াছে, নিজের হাতে বিছানা রৌদ্রে দিয়াছে, স্নানের সময় প্রত্যহ তাঁহাকে খবর দিয়া স্মরণ করাইয়া দিয়াছে— এই-সমস্ত অভ্যস্ত কাজের কোনো গুরুত্বই প্রতিদিন কোনো পক্ষ অনুভব করে না। কিন্তু এ-সকল অনাবশ্যক কাজও যখন বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার সময় উপস্থিত হয় তখন এই-সকল ছোটোখাটো সেবা, যাহা একজনে না করিলে অনায়াসে আর-এক জনে করিতে পারে, যাহা না করিলেও কাহারো বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, এইগুলিই দুই পক্ষের চিত্তকে মথিত করিতে থাকে। সুচরিতা আজকাল যখন পরেশের ঘরের কোনো সামান্য কাজ করিতে আসে তখন সেই কাজটা পরেশের কাছে মস্ত হইয়া দেখা দেয় ও তাহর বক্ষের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস জমা হইয়া উঠে। এবং এই কাজ আজ বাদে কাল অন্যের হাতে সম্পন্ন হইতে থাকিবে এই কথা মনে করিয়া সুচরিতার চোখ ছল্‌ছল্‌ করিয়া আসে।

 যেদিন মধ্যাহ্নে আহার করিয়া সুচরিতাদের নূতন বাড়িতে উঠিয়া যাইবার কথা সেদিন প্রাতঃকালে পরেশবাবু তাহার নিভৃত ঘরটিতে উপাসনা করিতে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার আসনের সম্মুখদেশ ফুল দিয়া সাজাইয়া ঘরের এক প্রান্তে সুচরিতা অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। লাবণ্য-লীলারাও উপাসনাস্থলে আজ আসিবে এইরূপ তাহারা পরামর্শ করিয়াছিল, কিন্তু ললিতা তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া আসিতে দেয় নাই। ললিতা জানিত, পরেশবাবুর নির্জন উপাসনায় যোগ দিয়া সুচরিতা যেন বিশেষভাবে তাঁহার আনন্দের অংশ

৩৩৯