পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রাত্রে শুইতে যাইবার আগে বলিতেছিল “কখনোই আমি হার মানিব না' এবং প্রতিদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানায় বসিয়া বলিয়াছে “কোনোমতেই আমি হার মানিব না'। এই-যে বিনয়ের চিন্তা তাহার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া বসিয়াছে, বিনয় নীচের ঘরে বসিয়া কথা কহিতেছে জানিতে পারিলে তাহার হৃৎপিণ্ডের রক্ত উতলা হইয়া উঠিতেছে, বিনয় দুই দিন তাহাদের বাড়িতে না আসিলে অবরুদ্ধ অভিমানে তাহার মন নিপীড়িত হইতেছে, মাঝে মাঝে সতীশকে নানা উপলক্ষে বিনয়ের বাসায় যাইবার জন্য উৎসাহিত করিতেছে এবং সতীশ ফিরিয়া আসিলে বিনয় কী করিতেছিল, বিনয়ের সঙ্গে কী কথা হইল, তাহার আদ্যোপান্ত সংবাদ সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতেছে— ইহা ললিতার পক্ষে যতই অনিবার্য হইয়া উঠিতেছে ততই পরাভবের গ্লানিতে তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। বিনয় ও গোরার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ে বাধা দেন নাই বলিয়া এক-এক বার পরেশবাবুর প্রতি তাহার রাগও হইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লড়াই করিবে, মরিবে তবু হারিবে না, এই তাহার পণ ছিল। জীবন যে কেমন করিয়া কাটাইবে সে সম্বন্ধে নানাপ্রকার কল্পনা তাহার মনের মধ্যে যাতায়াত করিতেছিল। য়ুরোপের লোকহিতৈষিণী রমণীদের জীবনচরিতে যে-সকল কীর্তিকাহিনী সে পাঠ করিয়াছিল সেইগুলি তাহার নিজের পক্ষে সাধ্য ও সম্ভবপর বলিয়া মনে হইতে লাগিল।

 একদিন সে পরেশবাবুকে গিয়া কহিল, “বাবা, আমি কি কোনো মেয়ে-ইস্কুলে শেখাবার ভার নিতে পারি নে?”

 পরেশবাবু তাঁহার মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ক্ষুধাতুর হৃদয়ের বেদনায় তাহার সকরুণ দুটি চক্ষু যেন কাঙাল হইয়া এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে। তিনি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “কেন পারবে না মা? কিন্তু তেমন মেয়ে-ইস্কুল কোথায়?”

 যে সময়ের কথা হইতেছে তখন মেয়ে-ইস্কুল বেশি ছিল না, সামান্য পাঠশালা ছিল এবং ভদ্রঘরের মেয়েরা শিক্ষয়িত্রীর কাজে তখন অগ্রসর হন নাই। ললিতা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “ইস্কুল নেই বাবা?”

৩৪৬