পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জন্মেছি বলেই কি নিজের মনখানাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে পড়ে আছাড় খেতে থাকব? পৃথিবীর কোনো কাজেই লাগব না?”

 ললিতার কথাটার মধ্যে যে বেদনা ছিল সুচরিতার বুকের মধ্যে গিয়া তাহা বাজিয়া উঠিল। সে কোনো উত্তর না করিয়া ভাবিতে লাগিল।

 ললিতা কহিল, “পাড়ায় তো অনেক মেয়ে আছে। আমরা যদি তাদের অমনি পড়াতে চাই বাপ-মা'রা তো খুশি হবে। তাদের যে-কজনকে পাই তোমার এই বাড়িতে এনে পড়ালেই হবে। এতে খরচ কিসের?”

 এই বাড়িতে রাজ্যের অপরিচিত ঘরের মেয়ে জড়ো করিয়া পড়াইবার প্রস্তাবে হরিমোহিনী উদ্‌বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। তিনি নিরিবিলি পূজা-অর্চনা লইয়া শুদ্ধ শুচি হইয়া থাকিতে চান, তাহার ব্যাঘাতের সম্ভাবনায় আপত্তি করিতে লাগিলেন।

 সুচরিতা কহিল, “মাসি, তোমার ভয় নেই, যদি ছাত্রী জোটে তাদের নিয়ে আমাদের নীচের তলার ঘরেই কাজ চালাতে পারব, তোমার উপরের ঘরে আমরা উৎপাত করতে আসব না। তা ভাই ললিতা, যদি ছাত্রী পাওয়া যায় তা হলে আমি রাজি আছি।”

 ললিতা কহিল, “আচ্ছা, দেখাই যাক-না।”

 হরিমোহিনী বার বার কহিলে লাগিলেন, “মা, সকল বিষয়েই তোমরা খৃস্টানের মতো হলে চলবে কেন? গৃহস্থ ঘরের মেয়ে ইস্কুলে পড়ায় এ তো বাপের বয়সে শুনি নি।”

 পরেশবাবুর ছাতের উপর হইতে আশ-পাশের বাড়ির ছাতে মেয়েদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় চলিত। এই পরিচয়ের একটা মস্ত কণ্টক ছিল, পাশের বাড়ির মেয়েরা এ বাড়ির মেয়েদের এত বয়সে এখনো বিবাহ হইল না বলিয়া প্রায়ই প্রশ্ন এবং বিস্ময় প্রকাশ করিত। ললিতা এই কারণে এই ছাতের আলাপে পারতপক্ষে যোগ দিত না।

 এই ছাতে ছাতে বন্ধুত্ব-বিস্তারে লাবণ্যই ছিল সকলের চেয়ে উৎসাহী। অন্য বাড়ির সাংসারিক ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে তাহার কৌতূহলের সীমা ছিল না।

৩৪৯