পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তিনি কি কখনো একটুও রাগ প্রকাশ করেছেন, ব্রাহ্মসমাজের নামে তাড়া দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছেন? এই নিয়ে মা কতদিন বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু বাবার কেবল একটিমাত্র এই ভয় ছিল পাছে আমরা নিজে চিন্তা করবার সাহস হারাই। এমন করে যখন তিনি আমাদের মানুষ করে তুলেছেন তখন শেষকালে কি তিনি পানুবাবুর মতো সমাজের জেল-দারোগার হাতে আমাকে সমর্পণ করে দেবেন?”

 সুচরিতা কহিল, “আচ্ছা বেশ, বাবা যেন কোনো বাধা দিলেন না, তার পরে কী করা যাবে বল্‌?”

 ললিতা কহিল, “তোমরা যদি কিছু না কর তা হলে আমি নিজে—"

 সুচরিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “না না, তোকে কিছু করতে হবে না ভাই! আমি একটা উপায় করছি।”

 সুচরিতা পরেশবাবুর কাছে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল, এমন সময় পরেশবাবু স্বয়ং সন্ধ্যাকালে তাহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই সময়ে পরেশবাবু প্রতিদিন তাঁহার বাড়ির বাগানে একলা মাথা নিচু করিয়া আপন মনে ভাবিতে ভাবিতে পায়চারি করিয়া থাকেন— সন্ধ্যার পবিত্র অন্ধকারটিকে ধীরে ধীরে মনের উপর বুলাইয়া কর্মের দিনের সমস্ত দাগগুলিকে যেন মুছিয়া ফেলেন এবং অন্তরের মধ্যে নির্মল শান্তি সঞ্চয় করিয়া রাত্রির বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত হইতে থাকেন— আজ পরেশবাবু সেই তাঁহার সন্ধ্যার নিভৃত ধ্যানের শান্তিসম্ভোগ পরিত্যাগ করিয়া যখন চিন্তিতমুখে সুচরিতার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন যে শিশুর খেলা করা উচিত ছিল সেই শিশু পীড়িত হইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিলে মার মনে যেমন ব্যথা বাজে সুচরিতার স্নেহপূর্ণ চিত্ত তেমনি ব্যথিত হইয়া উঠিল।

 পরেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “রাধে, সব শুনেছ তো?”

 সুচরিতা কহিল, “হাঁ বাবা, সব শুনেছি, কিন্তু তুমি অত ভাবছ কেন?”

 পরেশবাবু কহিলেন, “আমি তো আর কিছু ভাবি নে, আমার ভাবনা এই যে, ললিতা যে ঝড়টা জাগিয়ে তুলেছে তার সমস্ত আঘাত সইতে

৩৭৭