পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

বুদবুদ! ছোঃ!”

 বলিয়া গোরা বিনয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল; বিনয় কোনো উত্তর না করিয়া ভাবিতে লাগিল। গোরা কহিল, “এই যেখানে আমরা পড়ছি শুনছি, চাকরির উমেদারি করে বেড়াচ্ছি, দশটা-পাঁচটায় ভূতের খাটুনি খেটে কী যে করছি তার কিছুই ঠিকানা নেই, এই জাদুকরের মিথ্যে ভারতবর্ষটাকেই আমরা সত্য বলে ঠাউরেছি বলেই পচিশ কোটি লোক মিথ্যে মানকে মান ব’লে, মিথ্যে কর্মকে কর্ম ব’লে দিনরাত বিভ্রান্ত হয়ে বেড়াচ্ছি— এই মরীচিকার ভিতর থেকে কি আমরা কোনোরকম চেষ্টায় প্রাণ পাব! আমরা তাই প্রতিদিন শুকিয়ে মরছি। একটি সত্য ভারতবর্ষ আছে— পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ, সেইখানে স্থিতি না হলে আমরা কী বুদ্ধিতে কী হৃদয়ে যথার্থ প্রাণরসটা টেনে নিতে পারব না। তাই বলছি, আর সমস্ত ভুলে, কেতাবের বিদ্যে, খেতাবের মায়া, উঞ্ছবৃত্তির প্রলোভন সব টান মেরে ফেলে দিয়ে সেই বন্দরের দিকেই জাহাজ ভাসাতে হবে- ডুবি তো ডুবব, মরি তে মরব। সাধে আমি ভারতবর্ষের সত্য মূর্তি, পূর্ণ মূর্তি, কোনোদিন ভুলতে পারি নে!”

 বিনয়। এ-সব কেবল উত্তেজনার কথা নয়? এ তুমি সত্য বলছ?

 গোরা মেঘের মতো গর্জিয়া কহিল, “সত্যই বলছি।”

 বিনয়। যারা তোমার মতো দেখতে পাচ্ছে না?

 গোরা মুঠা বাঁধিয়া কহিল, “তাদের দেখিয়ে দিতে হবে। এই তো আমাদের কাজ। সত্যের ছবি স্পষ্ট না দেখতে পেলে লোকে আত্মসমর্পণ করবে কোন্ উপছায়ার কাছে। ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূতিটা সবার কাছে তুলে ধরো— লোকে তা হলে পাগল হয়ে যাবে। তখন কি দ্বারে দ্বারে চাঁদা সেধে বেড়াতে হবে। প্রাণ দেবার জন্যে ঠেলাঠেলি পড়ে যাবে।”

 বিনয়। হয় আমাকে সংসারের দশ জনের মতো ভেসে চলে যেতে দাও, নইলে আমাকে সেই মূর্তি দেখাও।

 গোরা। সাধনা করে। যদি বিশ্বাস মনে থাকে তা হলে কঠোর সাধনাতেই সুখ পাবে। আমাদের শৌখিন পেট্রিয়ট্‌দের সত্যকার বিশ্বাস

৩২