পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমি বিনয়বাবুকে রাস্তা থেকে ধরে এনেছি।”

 বিনয় লজ্জায় ঘামিয়া উঠিল; ঘরের মধ্যে এক মুহূর্তে ললিতা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, পরেশবাবু রাস্তার দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন-সবসুদ্ধ একটা কাণ্ড হইয়া গেল।

 তখন বিনয় সতীশকে বিদায় করিয়া পরেশবাবুর বাড়িতে উঠিল। তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, ললিতা চলিয়া গেছে। তাহাকে সকলেই শান্তিভঙ্গকারী দস্তুর মতো দেখিতেছে এই মনে করিয়া সে সংকুচিত হইয়া চৌকিতে বসিল।

 শারীরিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে সাধারণ শিষ্টালাপ শেষ হইতেই বিনয় একেবারেই আরম্ভ করিল, “আমি যখন হিন্দুসমাজের আচার-বিচারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মানি নে এবং প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করে থাকি তখন ব্রাহ্মসমাজে আশ্রয় গ্রহণ করাই আমার কর্তব্য বলে মনে করছি। আপনার কাছ থেকেই দীক্ষা গ্রহণ করি, এই আমার বাসনা।”

 এই বাসনা এই সংকল্প আর পনেরো মিনিট পূর্বেও বিনয়ের মনে স্পষ্ট আকারে ছিল না। পরেশবাবু ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিলেন, “ভালো করে সকল কথা চিন্তা করে দেখেছ তো?”

 বিনয় কহিল, “এর মধ্যে আর তো কিছু চিন্তা করবার নেই, কেবল ন্যায়-অন্যায়টাই ভেবে দেখবার বিষয়। সেটা খুব সাদা কথা। আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি তাতে কেবল আচার-বিচারকেই অলঙ্ঘনীয় ধর্ম বলে আমি কোনোমতেই অকপটচিত্তে মানতে পারি নে। সেইজন্যেই আমার ব্যবহারে পদে পদে নানা অসংগতি প্রকাশ পায়, যারা শ্রদ্ধার সঙ্গে হিঁদুয়ানিকে আশ্রয় করে আছে তাদের সঙ্গে জড়িত থেকে আমি তাদের কেবল আঘাতই দিই। এটা যে আমার পক্ষে নিতান্ত অন্যায় হচ্ছে তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এমন স্থলে আর-কোনো কথা চিন্তা না করে এই অন্যায় পরিহার করবার জন্যেই আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। নইলে নিজের প্রতি সম্মান রাখতে পারব না।”

৪২৬