পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 পরেশবাবুকে বুঝাইবার জন্য এত কথার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এসব কথা নিজেকেই জোর দিবার জন্য। সে যে একটা ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধের মধ্যেই পড়িয়া গেছে এবং এই যুদ্ধে সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া ন্যায়ের পক্ষেই তাহাকে জয়ী হইতে হইবে, এই কথা বলিয়া তাহার বক্ষ প্রসারিত হইয়া উঠিল। মনুষ্যত্বের মর্যাদা তো রাখিতে হইবে।

 পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তোমার মতের ঐক্য আছে তো?”

 বিনয় একটুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আপনাকে সত্য কথা বলি, আগে মনে করতুম আমার বুঝি একটা-কিছু ধর্মবিশ্বাস আছে তা নিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে অনেক ঝগড়াও করেছি। কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জেনেছি ধর্মবিশ্বাস আমার জীবনের মধ্যে পরিণতি লাভ করে নি। এটুকু যে বুঝেছি সে আপনাকে দেখে। ধর্মে আমার জীবনের কোনো সত্য প্রয়োজন ঘটে নি এবং তার প্রতি আমার সত্য বিশ্বাস জন্মে নি বলেই আমি কল্পনা এবং যুক্তিকৌশল দিয়ে এতদিন আমাদের সমাজের প্রচলিত ধর্মকে নানাপ্রকার সুক্ষ্মব্যাখ্যা-দ্বারা কেবলমাত্র তর্কনৈপুণ্যে পরিণত করেছি। কোন্ ধর্ম যে সত্য তা ভাববার আমার কোনো দরকারই হয় না; যে ধর্মকে সত্য বললে আমার জিত হয় আমি তাকেই সত্য বলে প্রমাণ করে বেড়িয়েছি। যতই প্রমাণ করা শক্ত হয়েছে ততই প্রমাণ করে অহংকার বোধ করেছি। কোনোদিন আমার মনে ধর্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ সত্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে কি না তা আজও আমি বলতে পারি নে, কিন্তু অনুকূল অবস্থা এবং দৃষ্টান্তের মধ্যে পড়লে সে দিকে আমার অগ্রসর হবার সম্ভাবনা আছে এ কথা নিশ্চিত। অন্তত যে জিনিস ভিতরে ভিতরে আমার বুদ্ধিকে পীড়িত করে চিরজীবন তারই জয়পতাকা বহন করে বেড়াবার হীনতা থেকে উদ্ধার পাব।”

 পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিতে কহিতেই বিনয় নিজের বর্তমান অবস্থার অনুকুল যুক্তিগুলিকে আকার দান করিয়া তুলিতে লাগিল। এমনি উৎসাহের সঙ্গে করিতে লাগিল যেন অনেক দিনের তর্কবিতর্কের পর সে এই স্থির

৪২৭