পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 গোরা একটু থামিল, সুচরিতাও চুপ করিয়া রহিল।

 গোরা কহিল, “আপনারা ব্রাহ্মমতে বিনয়ের বিবাহ দেবার চেষ্টা করছেন। এটা কি ভালো করছেন?”

 এই খোঁচাটুকু খাইয়া সুচরিতার মন হইতে লজ্জা-সংকোচের জড়তা একেবারে দূর হইয়া গেল। সে গোরার মুখের দিকে চোখ তুলিয়া কহিল, “ব্রাহ্মমতে বিবাহকে ভালো কাজ বলে মনে করব না, এই কি আপনি আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন?”

 গোরা কহিল, “আপনার কাছে আমি কোনোরকম ছোটো প্রত্যাশা করি নে, এ আপনি নিশ্চয় জানবেন। সম্প্রদায়ের লোকের কাছ থেকে মানুষ যেটুকু প্রত্যাশা করতে পারে আমি আপনার কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি করি। কোনো-একটা দলকে সংখ্যায় বড়ো করে ভোলাই যে-সমস্ত কুলির সর্দারের কাজ আপনি সে শ্রেণীর নন, এ আমি খুব জোর করে বলতে পারি। আপনি নিজেও যাতে নিজেকে ঠিকমত বুঝতে পারেন এইটে আমার ইচ্ছা। অন্য পাঁচজনের কথায় ভুলে আপনি নিজেকে ছোটো বলে জানবেন না। আপনি কোনো-একটি দলের লোকমাত্র নন, এ কথাটা আপনাকে নিজের মনের মধ্যে থেকে নিজে স্পষ্ট বুঝতে হবে।”

 সুচরিতা মনের সমস্ত শক্তিকে জাগাইয়া সতর্ক হইয়া শক্ত হইয়া বসিল। কহিল, “আপনিও কি কোনো দলের লোক নন?”

 গোরা কহিল, “আমি হিন্দু। হিন্দু তো কোনো দল নয়। হিন্দু একটা জাতি। এ জাতি এত বৃহৎ যে কিসে এই জাতির জাতিত্ব তা কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করে বলাই যায় না। সমুদ্র যেমন ঢেউ নয়, হিন্দু তেমনি দল নয়।”

 সুচরিতা কহিল, “হিন্দু যদি দল নয় তবে দলাদলি করে কেন?”

 গোরা কহিল, “মানুষকে মারতে গেলে সে ঠেকাতে যায় কেন? তার প্রাণ আছে বলে। পাথরই সকলরকম আঘাতে চুপ করে পড়ে থাকে।”

 সুচরিতা কহিল, “আমি যাকে ধর্ম বলে জ্ঞান করছি হিন্দু যদি তাকে

৪৪১