পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আঘাত বলে গণ্য করে, তবে সে স্থলে আমাকে আপনি কী করতে বলেন?”

 গোরা কহিল, “তখন আমি আপনাকে বলব যে, যেটাকে আপনি কর্তব্য মনে করছেন সেটা যখন হিন্দুজাতি বলে এতবড়ো একটি বিরাট সত্তার পক্ষে বেদনাকর আঘাত তখন আপনাকে খুব চিন্তা করে দেখতে হবে, আপনার মধ্যে কোনো ভ্রম কোনো অন্ধতা আছে কি না, আপনি সব দিক সকল রকম করে চিন্তা করে দেখেছেন কি না। দলের লোকের সংস্কারকে কেবলমাত্র অভ্যাস বা আলস্য -বশত সত্য বলে ধরে নিয়ে এতবড়ো একটা উৎপাত করতে প্রবৃত্ত হওয়া ঠিক নয়। ইদুর যখন জাহাজের খোল কাটতে থাকে তখন ইঁদুরের সুবিধা ও প্রবৃত্তির হিসাব থেকেই সে কাজ করে; দেখে না এতবড়ো একটা আশ্রয়ে ছিদ্র করলে তার যেটুকু সুবিধা তার চেয়ে সকলের কতবড় ক্ষতি। আপনাকেও তেমনি ভেবে দেখতে হবে, আপনি কি কেবল আপনার দলটির কথা ভাবছেন, না সমস্ত মানুষের কথা ভাবছেন। সমস্ত মানুষ বললে কতটা বোঝায় তা জানেন? তার কত রকমের প্রকৃতি, কত রকমের প্রবৃত্তি, কত রকমের প্রয়োজন? সব মানুষ এক পথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই কারও সামনে পাহাড়, কারও সামনে সমুদ্র, কারও সামনে প্রান্তর। অথচ কারও বসে থাকবার জো নেই, সকলকেই চলতে হবে। আপনি কেবল আপনার দলের শাসনটিকেই সকলের উপর খাটাতে চান? চোখ বুজে মনে করতে চান, মানুষের মধ্যে কোনো বৈচিত্র্যই নেই, কেবল,ব্রাহ্মসমাজের খাতায় নাম লেখাবার জন্যেই সকলে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে? যে-সকল দস্যজাতি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেই যুদ্ধে জয় করে নিজের একচ্ছত্র রাজত্ব বিস্তার করাকেই পৃথিবীর একমাত্র কল্যাণ বলে কল্পনা করে, অন্যান্য জাতির বিশেষত্ব যে বিশ্বহিতের পক্ষে বহুমূল্য বিধান নিজের বলগর্বে তা যারা স্বীকার করে না এবং পৃথিবীতে কেবল দাসত্ব বিস্তার করে, তাদের সঙ্গে আপনাদের প্রভেদ কোন্‌খানে!”

 সুচরিতা ক্ষণকালের জন্য তর্কযুক্তি সমস্তই ভুলিয়া গেল। গোরার রজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর একটি আশ্চর্য প্রবলতা -দ্বারা তাহার সমস্ত অন্তঃকরণকে

৪৪২