পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অভ্যন্ত পৃথিবীর প্রতিদিনের সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি হইতে কত দূরে! রাজ্যসাম্রাজ্যের কত উত্থানপতন, যুগযুগান্তরের কত প্রয়াস ও প্রার্থনাকে বহু দূরে অতিক্রম করিয়া ওইটুকু আকাশ এবং ওই ক’টি তারা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে; অথচ অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্য হইতে এক হৃদয় যখন আর-এক হৃদয়কে আহ্বান করে তখন নিভৃত জগৎ-প্রান্তের সেই বাক্যহীন ব্যাকুলতা যেন ওই দূর আকাশ এবং দূর তারাকে স্পন্দিত করিতে থাকে। কর্মরত কলিকাতার পথে গাড়ি-ঘোড়া ও পথিকের চলাচল এই মুহূর্তে গোরার চক্ষে ছায়াছবির মতো বস্তুহীন হইয়া গেল; নগরের কোলাহল কিছুই তাহার কাছে আর পৌঁছিল না; নিজের হৃদয়ের দিকে চাহিয়া দেখিল— সেও ওই আকাশের মতো নিস্তব্ধ, নিভৃত, অন্ধকার, এবং সেখানে জলে-ভরা দুইটি সরল সকরুণ চক্ষু নিমেষ হারাইয়া যেন অনাদি কাল হইতে অনন্ত কালের দিকে তাকাইয়া আছে।

 হরিমোহিনীর কণ্ঠ শুনিয়া গোরা চমকিয়া উঠিয়া মুখ ফিরাইল।

 “বাবা, কিছু মিষ্টিমুখ করে যাও।”

 গোরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আজ কিন্তু নয়। আজ আমাকে মাপ করতে হবে— আমি এখনি যাচ্ছি।”

 বলিয়া গোরা আর-কোনো কথার অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।

 হরিমোহিনী বিস্মিত হইয়া সুচরিতার মুখের দিকে চাহিলেন। সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। হরিমোহিনী মাথা নাড়িয়া ভাবিতে লাগিলেন— এ আবার কী কাণ্ড!

 অনতিকাল পরেই পরেশবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সুচরিতার ঘরে সুচরিতাকে দেখিতে না পাইয়া হরিমোহিনীকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী কোথায়?”

 হরিমোহিনী বিরক্তির কণ্ঠে কহিলেন, “কী জানি, এতক্ষণ তো গৌরমোহনের সঙ্গে বসবার ঘরে আলাপ চলছিল, তার পরে এখন বোধ হয় ছাতে

৪৬৯