মাত্রও করিতেছে না, তখন এক মুহূর্তে তাঁহার ক্রোধের শিখা ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত যেন বিদ্যুদ্বেগে জ্বলিয়া উঠিল। আত্মসম্বরণ করিয়া তিনি দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, “রাধারানী।”
সুচরিতা উঠিয়া তাঁহার কাছে আসিলে তিনি মৃদুস্বরে কহিলেন, “আজ একাদশী, আমার শরীর ভালো নেই, যাও তুমি রান্নাঘরে গিয়ে উনানটা ধরাও গে— আমি তত ক্ষণ গৌরবাবুর কাছে একটু বসি।”
সুচরিতা মাসির ভাব দেখিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল। হরিমোহিনী ঘরে প্রবেশ করিতে গোরা তাঁহাকে প্রণাম করিল। তিনি কোনো কথা না কহিয়া চৌকিতে বসিলেন। কিছু ক্ষণ ঠোঁট চাপিয়া চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “তুমি তো, বাবা, ব্রাহ্ম নও?”
গোরা কহিল, “না।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “আমাদের হিন্দুসমাজকে তুমি তো মানে?”
গোরা কহিল, “মানি বৈকি।”
হরিমোহিনী কহিলেন, “তবে তোমার এ কী রকম ব্যবহার!”
গোরা হরিমোহিনীর অভিযোগ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানীর বয়স হয়েছে, তোমরা তো ওর আত্মীয় নও- ওর সঙ্গে তোমাদের এত কী কথা! ও মেয়েমানুষ, ঘরের কাজকর্ম করবে, ওরই-বা এ-সব কথায় থাকবার দরকার কী? ওতে যে ওর মন অন্য দিকে নিয়ে যায়। তুমি তো জ্ঞানী লোক- দেশসুদ্ধ সকলেই তোমার প্রশংসা করে- কিন্তু এ-সব আমাদের দেশে কবেই-বা ছিল আর কোন্ শাস্ত্রেই-বা লেখে!”
গোরা হঠাৎ একটা মস্ত ধাক্কা পাইল। সুচরিতার সম্বন্ধে এমন কথা যে কোনো পক্ষ হইতে উঠিতে পারে তাহা সে চিন্তাও করে নাই। সে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “ইনি ব্রাহ্মসমাজে আছেন, বরাবর এঁকে এইরকম সকলের সঙ্গে মিশতে দেখেছি, সেইজন্যে আমার কিছু মনে হয় নি।”
৪৯১