পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 কৃষ্ণদয়াল। বেশ! সব দোষ বুঝি আমার! গোড়ায় তুমি যে ভুল করলে। তুমি যে ওকে কোনোমতেই ছাড়তে চাইলে না। তখন আমিও গোঁয়ারগোছের ছিলুম, ধর্মকর্ম কোনো কিছুর তো জ্ঞান ছিল না। এখন হলে কি এমন কাজ করতে পারতুম।

 আনন্দময়ী। কিন্তু যাই বল, আমি যে কিছু অধর্ম করেছি সে আমি কোনোমতে মানতে পারব না। তোমার তো মনে আছে, ছেলে হবার জন্যে আমি কী না করেছি— যে যা বলেছে তাই শুনেছি— কত মাদুলি, কত মন্তর নিয়েছি সে তো তুমি জানই। একদিন স্বপ্নে দেখলুম, যেন সাজি ভরে টগর ফুল নিয়ে এসে ঠাকুরের পুজো করতে বসেছি— এক সময় চেয়ে দেখি সাজিতে ফুল নেই, ফুলের মতো ধব্‌ধবে একটি ছোট্ট ছেলে! আহা, সে কী দেখেছিলুম, সে কী বলব। আমার দুই চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল; তাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিতে যাব আর ঘুম ভেঙে গেল। তার দশ দিন না যেতেই তো গোরাকে পেলুম— সে আমার ঠাকুরের দান— সে কি আর কারও যে আমি কাউকে ফিরিয়ে দেব। আর-জন্মে তাকে গর্ভে ধারণ করে বোধ হয় অনেক কষ্ট পেয়েছিলুম তাই আজ সে আমাকে ‘মা’ বলতে এসেছে। কেমন করে কোথা থেকে সে এল ভেবে দেখো দেখি। চারি দিকে তখন মারামারি কাটাকাটি, নিজের প্রাণের ভয়েই মরি, সেই সময় রাত-দুপুরে সেই মেম যখন আমাদের বাড়িতে এসে লুকোল তুমি তো তাকে ভয়ে বাড়িতে রাখতেই চাও না— আমি তোমাকে ভাঁড়িয়ে তাকে গোয়ালঘরে লুকিয়ে রাখলুম। সেই রাত্রেই ছেলেটি প্রসব করে সে তো মারা গেল। সেই বাপ-মা-মরা ছেলেকে আমি যদি না বাঁচাতুম তো সে কি বাঁচত। তোমার কী। তুমি তো পাদ্রির হাতে ওকে দিতে চেয়েছিলে। কেন, পাদ্রিকে দিতে যাব কেন। পাদ্রি কি ওর মা বাপ, না ওর প্রাণরক্ষা করেছে? এমন করে যে ছেলে পেয়েছি সে কি গর্ভে পাওয়ায় চেয়ে কম। তুমি যাই বল, এ ছেলে যিনি আমাকে দিয়েছেন তিনি স্বয়ং যদি না নেন তবে প্রাণ গেলেও আর-কাউকে নিতে দিচ্ছি নে।

৪২