পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

বাপু, এমন-সব কথা আমি সাত জন্মে শুনি নাই।’

 সুচরিতাকে কিছু শান্ত হইতে সময় দিয়া কিছু ক্ষণ পরে তাহাকে আহারে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। সে খাইতে বসিলে তাহাকে বলিলেন, “দেখো রাধারানী, আমার তো বয়স নিতান্ত কম হয় নি। হিন্দুধর্মে যা বলে তা তো শিশুকাল থেকে করে আসছি, আর শুনেওছি বিস্তর। তুমি এ-সব কিছুই জান না, সেই জন্যেই গৌরমোহন তোমার গুরু হয়ে তোমাকে কেবল ভোলাচ্ছে। আমি তো ওঁর কথা কিছু কিছু শুনেছি- ওর মধ্যে আদত কথা কিছুই নেই, ও শাস্ত্র ওঁর নিজের তৈরি। এ-সব আমাদের কাছে ধরা পড়ে, আমরা গুরু-উপদেশ পেয়েছি। আমি তোমাকে বলছি, রাধারানী, তোমাকে এসব কিছুই করতে হবে না- যখন সময় হবে, আমার যিনি গুরু আছেন তিনি তো এমন ফাঁকি নন, তিনিই তোমাকে মন্ত্র দেবেন। তোমার কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে হিন্দুসমাজে ঢুকিয়ে দেব। ব্রাহ্মঘরে ছিলে, না হয় ছিলে। কেই-বা সে খবর জানবে। তোমার বয়স কিছু বেশি হয়েছে বটে, তা এমন বাড়ন্ত মেয়ে ঢের আছে। কেই-বা তোমার কুষ্ঠি দেখছে। আর, টাকা যখন আছে তখন কিছুতেই কিছু বাধবে না, সবই চলে যাবে। কৈবর্তর ছেলে কায়স্থ বলে চলে গেল, সে তো আমি নিজের চক্ষে দেখেছি। আমি হিন্দুসমাজে এমন সদ্‌ব্রাহ্মণের ঘরে তোমাকে চালিয়ে দেব, কারও সাধ্য থাকবে না কথা বলে- তারাই হল সমাজের কর্তা। এ জন্যে তোমাকে এত গুরুর সাধ্যসাধনা এত কান্নাকাটি করে মরতে হবে না।”

 এই-সকল কথা হরিমোহিনী যখন বিস্তারিত করিয়া ফলাইয়া ফলাইয়া বলিতেছিলেন, সুচরিতার তখন আহারে রুচি চলিয়া গিয়াছিল, তাহার গলা দিয়া যেন গ্রাস গলিতেছিল না। কিন্তু সে নীরবে অত্যন্ত জোর করিয়াই খাইল; কারণ, সে জানিত, তাহার কম খাওয়া লইয়াই এমন আলোচনার সৃষ্টি হইবে যাহা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র উপাদেয় হইবে না।

 হরিমোহিনী যখন সুচরিতার কাছে বিশেষ কোন সাড়া পাইলেন না তখন তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘গড় করি, ইহাদিগকে গড় করি। এ দিকে

৫১৮