পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

ঋণাত্মক নহে, যাহা ধনাত্মক; যাহার জন্য মানুষ এক আহবানে এক মুহূর্তে একসঙ্গে দাঁড়াইয়া অনায়াসে প্রাণবিসর্জন করিতে পারে।

 শিক্ষিতসমাজে গোরা যখন লিখিয়াছে, তর্ক করিয়াছে, বক্তৃতা দিয়াছে, তখন সে অন্যকে বুঝাইবার জন্য, অন্যকে নিজের পথে আনিবার জন্য, স্বভাবতই নিজের কথাগুলিকে কল্পনার দ্বারা মনোহর বর্ণে রঞ্জিত করিয়াছে; যাহা স্থূল তাহাকে সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার দ্বারা আবৃত করিয়াছে; যাহা অনাবশ্যক ভগ্নাবশেষমাত্র তাহাকেও ভাবের চন্দ্রালোকে মোহময় ছবির মতো করিয়া দেখাইয়াছে। দেশের একদল লোক দেশের প্রতি বিমুখ বলিয়াই, দেশের সমস্তই তাহারা মন্দ দেখে বলিয়াই, স্বদেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ বশত গোরা এই মমত্ববিহীন দৃষ্টিপাতের অপমান হইতে বাঁচাইবার জন্য স্বদেশের সমস্তকেই অত্যুজ্জ্বল ভাবের আবরণে ঢাকিয়া রাখিতে অহোরাত্র চেষ্টা করিয়াছে। ইহাই গোরার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। সবই ভালো, যাহাকে দোষ বলিতেছ তাহা কোনো একভাবে, গুণ, ইহা যে গোরা কেবল উকিলের মতো প্রমাণ করিত তাহা নহে, ইহাই সে সমস্ত মন দিয়া বিশ্বাস করিত। নিতান্ত অসম্ভব স্থানেও এই বিশ্বাসকে স্পর্ধার সহিত জয়পতাকার মতো দৃঢ় মুষ্টিতে সমস্ত পরিহাসপরায়ণ শত্রুপক্ষের সম্মুখে সে একা খাড়া করিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার কেবল একটিমাত্র কথা ছিল, স্বদেশের প্রতি স্বদেশবাসীর শ্রদ্ধা সে ফিরাইয়া আনিবে, তাহার পরে অন্য কাজ।

 কিন্তু যখন সে পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করে তখন তো তাহার সম্মুখে কোনো শ্রোতা থাকে না, তখন তো তাহার প্রমাণ করিবার কিছুই নাই, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষকে নত করিয়া দিবার জন্য তাহার সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগ্রত করিয়া তুলিবার কোনো প্রয়োজন থাকে না- এইজন্য সেখানে সত্যকে সে কোনোপ্রকার আবরণের ভিতর দিয়া দেখে না। দেশের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রবলতাই তাহার সত্যদৃষ্টিকে অসামান্যরূপে তীক্ষ্ণ করিয়া দেয়।

৫৪১