পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

পদার্থটিকে হৃদয় পূর্ণ করিয়া পাইয়াছে এ কি সকলে পায়! ইহাকে গ্রহণ করিবার শক্তি কি সকলের আছে। সংসারে সাধারণত স্ত্রীপুরুষের যে মিলন দেখা যায়, বিনয় কহিল, তাহার মধ্যে এই উচ্চতম সুরটি তত বাজিতে শুনা যায় না। বিনয় গোরাকে বার বার করিয়া কহিল, অন্য-সকলের সঙ্গে সে যেন তাহাদের তুলনা না করে। বিনয়ের মনে হইতেছে, ঠিক এমনটি আরকখনো ঘটিয়াছে কি না সন্দেহ। এমন যদি সচরাচর ঘটিতে পারিত তবে বসন্তের এক হাওয়াতেই যেমন সমস্ত বন নব নব পুষ্পপল্লবে পুলকিত হইয়া উঠে, সমস্ত সমাজ তেমনি প্রাণের হিল্লোলে চারি দিকে চঞ্চল হইয়া উঠিত। তাহা হইলে লোকে এমন করিয়া খাইয়া-দাইয়া, ঘুমাইয়া, দিব্য তৈলচিক্কণ হইয়া কাটাইতে পারিত না। তাহা হইলে যাহার মধ্যে যত সৌন্দর্য যত শক্তি আছে স্বভাবতই নানা বর্ণে নানা আকারে দিকে দিকে উন্মীলিত হইয়া উঠিত। এ যে সোনার কাঠি- ইহার স্পর্শকে উপেক্ষা করিয়া অসাড় হইয়া কে পড়িয়া থাকিতে পারে! ইহাতে সামান্য লোককেও যে অসামান্য করিয়া তোলে। সেই প্রবল অসামান্যতার স্বাদ মানুষ জীবনে যদি একবারও পায় তবে জীবনের সত্য পরিচয় সে লাভ করে!

 বিনয় কহিল, ‘গোরা, আমি তোমাকে নিশ্চয় বলিতেছি, মানুষের সমস্ত প্রকৃতিকে এক মুহুর্তে জাগ্রত করিবার উপায় এই প্রেম- যে কারণেই হউক আমাদের মধ্যে এই প্রেমের আবির্ভাব দুর্বল, সেইজন্যই আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সম্পূর্ণ উপলব্ধি হইতে বঞ্চিত, আমাদের কী আছে তাহা আমরা জানি না, যাহা গোপনে আছে তাহাকে প্রকাশ করিতে পারিতেছি না, যাহা সঞ্চিত আছে তাহাকে ব্যয় করা আমাদের অসাধ্য- সেইজন্যই চারি দিকে এমন নিরানন্দ, এমন নিরানন্দ। সেইজন্যই আমাদের নিজের মধ্যে যে কোনো মাহাত্ম্য আছে তাহা কেবল তোমাদের মতো দুই-এক জনেই বোঝে; সাধারণের চিত্তে তাহার কোনো চেতনা নাই।’

 মহিম সশব্দে হাই তুলিয়া বিছানা হইতে উঠিয়া যখন মুখ ধুইতে গেলেন

৫৪৮