পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 এইজন্য গোরা নিজের জীবনের ছোটো ছোটো ঘটনারও একটা বিশেষ অর্থ বুঝিতে চেষ্টা করিত। আজ যখন সে আপনার মনের এত বড় একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষাবেগের মুখে হঠাৎ আসিয়া সুচরিতার দরজা বন্ধ দেখিল এবং দরজা খুলিয়া যখন শুনিল সুচরিতা নাই, তখন সে ইহাকে একটি অভিপ্রায়পূর্ণ ঘটনা বলিয়াই গ্রহণ করিল। তাহাকে যিনি চালনা করিতেছেন তিনি গোরাকে আজ এমনি করিয়া নিষেধ জানাইলেন। এ জীবনে সুচরিতার দ্বার তাহার পক্ষে রুদ্ধ, সুচরিতা তাহার পক্ষে নাই। গোরার মতো মানুষকে নিজের ইচ্ছা লইয়া মুগ্ধ হইলে চলিবে না, তাহার নিজের সুখদুঃখ নাই। সে ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ, ভারতবর্ষের হইয়া দেবতার আরাধনা তাহাকে করিতে হইবে, ভারতবর্ষের হইয়া তপস্যা তাহারই কাজ। আসক্তি-অনুরক্তি তাহার নহে। গোরা মনে মনে কহিল, ‘বিধাতা আসক্তির রূপটা আমার কাছে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়া দিলেন; দেখাইলেন তাহা শুভ্র নহে, শান্ত নহে, তাহা মদের মতো রক্তবর্ণ ও মদের মধ্যে তীব্র; তাহা বুদ্ধিকে স্থির থাকিতে দেয় না, তাহা এককে আর করিয়া দেখায়- আমি সন্ন্যাসী, আমার সাধনার মধ্যে তাহার স্থান নাই।’


৭০

অনেক দিন পীড়নের পর এ কয়েক দিন আনন্দময়ীর কাছে সুচরিতা যেমন আরাম পাইল এমন সে কোনোদিন পায় নাই। আনন্দময়ী এমনি সহজে তাহাকে এত কাছে টানিয়া লইয়াছেন যে, কোনোদিন যে তিনি তাহার অপরিচিতা বা দূর ছিলেন তাহা সুচরিতা মনেও করিতে পারে না। তিনি কেমন এক রকম করিয়া সুচরিতার সমস্ত মনটা যেন বুঝিয়া লইয়াছেন, এবং কোনো কথা না কহিয়াও তিনি সুচরিতাকে যেন একটা গভীর সান্ত্বনা দান করিতেছেন। ‘মা’ শব্দটাকে সুচরিতা তাহার সমস্ত হৃদয় দিয়া এমন করিয়া আর কখনো উচ্চারণ করে নাই। কোনো প্রয়োজন না থাকিলেও

৫৫২