পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

ও বাহিরে তাঁহার বন্ধুবান্ধবেরা তাঁহাকে একটুও শান্তির অবকাশ দিতেছিল না। কিছুদিনের জন্যও যদি তিনি দূরে গিয়া কাটাইয়া না আসেন, তবে ঘরে কেবলই তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া একটা আবর্ত ঘুরিতে থাকিবে। কাল তিনি বিদেশে যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছেন, অথচ আজ তাঁহার আপনার লোক কেহই তাঁহার কাপড় গুছাইয়া দিতে আসিল না, তাঁহার নিজেকেই এ কাজ করিতে হইতেছে- এই দৃশ্য দেখিয়া সুচরিতার মনে খুব একটা আঘাত লাগিল। সে পরেশবাবুকে নিরস্ত করিয়া প্রথমে তাঁহার তোরঙ্গ সম্পূর্ণ উজাড় করিয়া ফেলিল। তাহার পরে বিশেষ যত্নে ভাঁজ করিয়া কাপড়গুলিকে নিপুণ হস্তে তোরঙ্গের মধ্যে আবার সাজাইতে লাগিল, এবং তাঁহার সর্বদাপাঠ্য বইগুলিকে এমন করিয়া রাখিল যাহাতে নাড়াচাড়াতেও তাহাদের আঘাত না লাগে। এইরূপে বাক্স গুছাইতে গুছাইতে সুচরিতা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি একলাই যাবে?”

 পরেশ সুচরিতার এই প্রশ্নের মধ্যে বেদনার আভাস পাইয়া কহিলেন, “তাতে আমার তো কোনো কষ্ট নেই রাধে।”

 সুচরিতা কহিল, “না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে যাব।”

 পরেশ সুচরিতার মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন। সুচরিতা কহিল, “বাবা, আমি তোমাকে কিছু বিরক্ত করব না।”

 পরেশ কহিলেন, “সে কথা কেন বলছ! আমাকে তুমি কবে বিরক্ত করেছ মা?”

 সুচরিতা কহিল, “তোমার কাছে না থাকলে আমার ভালো হবে না। বাবা। আমি অনেক কথাই বুঝতে পারি নে। তুমি আমাকে বুঝিয়ে না দিলে আমি কিনারা পাব না। বাবা, তুমি যে আমাকে আমার নিজের বুদ্ধির উপরে নির্ভর করতে বল, আমার সে বুদ্ধি নেই, আমি মনের মধ্যে সে জোরও পাচ্ছি নে। তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো বাবা।”

 এই বলিয়া সে পরেশের দিকে পিঠ করিয়া অত্যন্ত নতশিরে তোরঙ্গের

৫৮৩