পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 আনন্দময়ী কহিলেন, “এখন একটু ভালোই আছেন। সাহেব-ডাক্তার ডাকতে গেছে।”

 ঘরে শশিমুখী এবং একজন চাকর ছিল। কৃষ্ণদয়াল হাত নাড়িয়া তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলেন।

 যখন দেখিলেন সকলে চলিয়া গেল তখন তিনি নীরবে আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিলেন এবং গোরাকে মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, “আমার সময় হয়ে এসেছে। এতদিন তোমার কাছে যা গোপন ছিল, আজ তোমাকে তা না বলে গেলে আমার মুক্তি হবে না।”

 গোরার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। অনেক ক্ষণ কেহ কোনো কথা কহিল না॥

 কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “গোরা, তখন আমি কিছু মানতুম না, সেই জন্যই এতবড়ো ভুল করেছি। তার পরে আর ভ্রমসংশোধনের পথ ছিল না।”

 এই বলিয়া আবার চুপ করিলেন। গোরাও কোনো প্রশ্ন না করিয়া নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিল।

 কৃষ্ণদয়াল কহিলেন, “মনে করেছিলুম, কোনোদিনই তোমাকে বলবার আবশ্যক হবে না, যেমন চলছে এমনিই চলে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, সে হবার জো নেই; আমার মৃত্যুর পরে তুমি আমার শ্রাদ্ধ করবে কী করে!”

 এরূপ প্রমাদের সম্ভাবনা মাত্রে কৃষ্ণদয়াল যেন শিহরিয়া উঠিলেন। আসল কথাটি কী তাহা জানিবার জন্য গোরা অধীর হইয়া উঠিল। সে আনন্দময়ীর দিকে চাহিয়া কহিল, “মা, তুমি বলো, কথাটা কী। শ্রাদ্ধ করবার অধিকার আমার নেই?”

 আনন্দময়ী এতক্ষণ মুখ নত করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিলেন। গোরার প্রশ্ন শুনিয়া তিনি মাথা তুলিলেন, এবং গোরার মুখের উপর দৃষ্টি স্থির রাখিয়া কহিলেন, “না, বাবা, নেই।”

 গোরা চকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি ওঁর পুত্র নই?”

 আনন্দময়ী কহিলেন, “না।”

৫৮৩