পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

কেউ বাপের পরিচয় দিতে লজ্জা করে।”

 বরদা। আগে তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন না?

 গোরা। আমিও তো এক সময়ে ব্রাহ্ম ছিলুম।

 বরদা। এখন আপনি সাকার উপাসনায় বিশ্বাস করেন?

 গোরা। আকার জিনিসটাকে বিনা কারণে অশ্রদ্ধা করব, আমার মনে এমন কুসংস্কার নেই। আকারকে গাল দিলেই কি সে ছোটো হয়ে যায়? আকারের রহস্য কে ভেদ করতে পেরেছে?

 পরেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “আকার যে অন্তবিশিষ্ট।”

 গোরা কহিল, “অন্ত না থাকলে যে প্রকাশই হয় না। অনন্ত আপনাকে প্রকাশ করবার জন্যই অনন্তকে আশ্রয় করেছেন— নইলে তাঁর প্রকাশ কোথায়। যার প্রকাশ নেই তার সম্পূর্ণতা নেই। বাক্যের মধ্যে যেমন ভাব তেমনি আকারের মধ্যে নিরাকার পরিপূর্ণ।”

 বরদা মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “নিরাকারের চেয়ে আকার সম্পূর্ণ, আপনি এমন কথা বলেন?”

 গোরা। আমি যদি নাও বলতুম তাতে কিছুই আসত যেত না। জগতে আকার আমার বলার উপর নির্ভর করছে না। নিরাকারই যদি যথার্থ পরিপূর্ণতা হত তবে আকার কোথাও স্থান পেত না।

 সুচরিতার অত্যন্ত ইচ্ছা করিতে লাগিল, কেহ এই উদ্ধত যুবককে তর্কে একেবারে পরাস্ত লাঞ্ছিত করিয়া দেয়। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া গোরার কথা শুনিতেছে দেখিয়া তাহার মনে মনে রাগ হইল। গোরা এতই জোরের সঙ্গে কথা বলিতেছিল যে, এই জোরকে নত করিয়া দিবার জন্য সুচরিতার মনের মধ্যেও যেন জোর করিতে লাগিল।

 এমন সময়ে বেহারা চায়ের জন্য কাৎলিতে গরম জল আনিল। সুচরিতা উঠিয়া চা তৈরি করিতে নিযুক্ত হইল। বিনয় মাঝে মাঝে চকিতের মতো সুচরিতার মুখের দিকে চহিয়া লইল। যদিচ উপাসনা সম্বন্ধে গোরার সঙ্গে বিনয়ের মতের বিশেষ পার্থক্য ছিল না, তবু গোরা যে এই ব্রাহ্ম-পরিবারের

৬৫