পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

তাহাতে কাহারও সন্দেহ ছিল না এবং ইহাই লইয়া মেয়েরা সুচরিতাকে সর্বদা ঠাট্টা করিতে ছাড়িত না।

 পানুবাবু ইস্কুলে মাস্টারি করেন। বরদাসুন্দরী তাঁহাকে ইস্কুলমাস্টার মাত্র জানিয়া বড় শ্রদ্ধা করেন না। তিনি ভাবে দেখান যে, পানুবাবু যে তাঁহার কোনো মেয়ের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করিতে সাহস করেন নাই সে ভালোই হইয়াছে। তাঁহার ভাবী জামাতারা ডেপুটিগিরির লক্ষ্যবেধরূপ অতি দুঃসাধ্য পণে আবদ্ধ।

 সুচরিতা হারানকে এক পেয়ালা চা অগ্রসর করিয়া দিতেই লাবণ্য দূর হইতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু মুখ টিপিয়া হাসিল। সেই হাসিটুকু বিনয়ের অগোচর রহিল না। অতি অল্প কালের মধ্যেই দুই-একটা বিষয়ে বিনয়ের নজর বেশ একটু তীক্ষ্ণ এবং সতর্ক হইয়া উঠিয়াছে— দর্শননৈপুণ্য সম্বন্ধে পূর্বে সে প্রসিদ্ধ ছিল না।

 এই-যে হারান ও সুধীর এ বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে অনেক দিন হইতে পরিচিত, এবং এই পারিবারিক ইতিহাসের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত যে তাহারা মেয়েদের মধ্যে পরস্পর ইঙ্গিতের বিষয় হইয়া পড়িয়াছে, বিনয়ের বুকের মধ্যে ইহা বিধাতার অবিচার বলিয়া বাজিতে লাগিল।

 এ দিকে হারানের অভ্যাগমে সুচরিতার মন যেন একটু আশান্বিত হইয়া উঠিল। গোরার স্পর্ধা যেমন করিয়া হউক কেহ দমন করিয়া দিলে তবে তাহার গায়ের জ্বালা মেটে। অন্য সময়ে হারানের তার্কিকতায় সে অনেকবার বিরক্ত হইয়াছে, কিন্তু আজ এই তর্কবীরকে দেখিয়া সে আনন্দের সঙ্গে তাঁহাকে চা ও পাঁউরুটির রসদ জোগাইয়া দিল।

 পরেশ কহিল, “পানুবাবু, ইনি আমাদের—”

 হারান কহিলেন, “ওঁকে বিলক্ষণ জানি। উনি এক সময়ে আমাদের ব্রাহ্মসমাজের একজন খুব উৎসাহী সভ্য ছিলেন।”

 এই বলিয়া গোরার সঙ্গে কোনোপ্রকার আলাপের চেষ্টা না করিয়া হারান চায়ের পেয়ালার প্রতি মন দিলেন।

৬৮